writerfair

দুরের কার্নিশ

The Far Cornish

Wahid Zaman

প্রথম অংশ

মন খারাপ বলে নদীর পাড়ে এসে বসে জহির । গত কয়েক দিন ধরে তার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। নদীর ধারে সময় কাটালে ওর মন ভালো হয়ে যায়। নদীর পাড়ে সারি সারি ক্যাওড়া গাছের ডালে বিকালের নীড়ে ফেরা পাখিদের কলরব তার মন ভালো করে দেয়।

রুমানা জহিরকে বাড়িতে না পেয়ে নদীর পাড়ে আসে । সে জানে পড়ন্ত বিকেলে জহির ওখানে থাকে । দূর থেকে দেখে জহিরকে চিনতে পারে । কাছে এসে অস্বাভাবিক শব্দ করে ভড়কে দেয় জহিরকে। বিরক্ত জহির প্রশ্ন করে, এটা কি হলো?

- কেন ভয় পেয়েছো নাকি?
- ভয় পাইনি কিন্তু বিরক্ত হয়েছি।
- তা তো হবারই কথা । মনে নতুন রং লাগলে এরকম তো হবেই
- ঝগড়া করার জন্য বলছ?
- তোমার সাথে ঝগড়া করতে পারলেও তো হতো।

জহির রুমানার কথার আগামাথা কিছু বুঝতে পারে না। তাই কিছুটা বিরক্তের সুরে বলে, পরিষ্কার করে বল। আমি এতো বাকা কথা বুঝিনা।

রুমানা চুপচাপ থাকে। কিছু দিন ধরে জহির তাকে এড়িয়ে চলছে তার ঝাল মেটাতে চায়। রুমানাকে হঠাৎ নীরব দেখে জহির আবার বলে, কি হলো । রুমানা ঝটপট বলে, কিছু না।

তারপর একবিন্দু না দীড়িয়ে চলে যায়। জহির অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে । একবারও তাকে থাকার অনুরোধ না করে নদীর পাড়ে আছড়ে পড়া টেউ দেখতে শুরু করে। সূর্য অস্ত্রচলে গেলে বাসায় ফেরে।

Page No 1


দ্বিতীয় অংশ

ইদানীং জহির ভীষণ নীরব থাকে । ঘর থেকে খুব কমই বাহিরে যায়। গত বই মেলায় তার দু'টি বই প্রকাশিত হয়েছিল । বাজারে বই দুটোর কাটতি যথেষ্ট ভালো । তাই প্রকাশকরা তার দিকে ঝুঁকছে বেশি। আগামী বই মেলার নতুন বইয়ের জন্য জহির অনেক ব্যন্ত। এজন্য রুমানা ও একমাত্র পুত্র রুম্মানের দিকে খেয়াল করার সময় পায় না।

রুমানা ছেলেকে নিয়ে ব্যন্ত সময় পার করে । সকালে স্কুলে নেওয়া, স্কুল শেষে বাসায় আনা, বিকেলে কোচিং এ নেওয়া ইত্যাদি করে তার কখন যে দিন পার হয়ে যায় সে টের পায় না। কিন্তু জহিরকে সে প্রতি মুহুর্তে কিল করে। জহির আবার সম্পূর্ণ রিভার্স । তার ব্যস্ততা বাড়লে চারপাশে মহা প্রলয় হলেও একবিন্দু কিরে দেখেন না। রুমানার বেদনাটা ঠিক এইখানে ।

কিছুক্ষণ আগে প্রকাশনা থেকে আফজাল সাহেব এসে হাজির । জহির তার সাথে নতুন বইয়ের ব্যাপারে আলাপে ব্যাস্ত। আফজাল সাহেব কথার মাঝে জিগ্গেস করলেন নতুন বইয়ের ব্যাপারে । বললেন, স্যার নতুন বইটার কাহিনি তো বললেন না

 

- কাহিনি জেনে লাভ কী

- না মানে, আগের বইগুলোর প্রেক্ষাপট, কাহিনি সবইতো আগে থেকে বলতেন । কিন্তু নতুন বইয়ের ব্যাপারে কিছুই জানতে পারিনি তাই আরকি ।

জহির চৌধুরী কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন, সব কিছু জানতে হবে কেন? আমার লেখার বিষয়ে সন্দেহ আছে

কোন?

- না না স্যার। আপনি না চাইলে দরকার নেই। আপনার লেখা দেশের সবারই পছন্দ।

কাউকে কিছু বলতে চাই না। আপনি আপনার মতো করে চলেন । আপনার লেখার ব্যাপারে আমাদের যথেষ্ট ট্রাস্ট আছে।

এরই মধ্যে রুমানা চা নাস্তা নিয়ে আসেন । আফজাল সাহেব উঠে সম্মান জানায়। লেখার ব্যাপারে কথা বলে। আফজাল সাহেব কিছু টাকা এ্যাডভানসড এনেছেন তা রুমানার হাতে তুলে দেয়। প্রকাশনার সাথে সকল অর্থনৈতিক লেনদেন সব রুমানাই করে। জহির চৌধুরী এসব বিষয়ে কোন আলোচনা করেন না। আ্যাডভান্স এর টাকা রুমানার হাতে দিয়ে আফজাল সাহেব বলেন, ম্যাডাম আরও বেশি দিতে পারলে ভালো হতো । কিন্তু এ মুহুর্তে পারছি না ।

 

- ঠিক আছে। চেষ্টা করুন চলতি মাসের শেষে আ্যাডভান্স এর বাকিটা দিতে ।

-জ্বি ম্যাডাম।

কথা শেষ করে আফজাল সাহেব বিদায় নেন। রুমানা জহিরকে বলে, তোমার এরকম রিজার্ভ থাকার কারণ কী জানতে পারি ।

জহির কোন উত্তর দেয় না। কলম তুলে নিয়ে লেখা শুরু করে । রুমানা বিরক্ত হয়ে ওঠে চলে যায়।

Page No 2


তৃতীয় অংশ

কয়েক দিন হলো রুমানার মধ্যে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করে জহির । রুমানাকে স্কুলে দিয়ে ছুটি পর্যন্ত এই মধ্যবতী সময়ে রুমানা বাসায় ফিরে না। আগে রুম্মান মাঝে মধ্যে স্কুলে যেতে না চাইলে রুমানা জোর করত না। জহির স্কুলে যাওয়ার জন্য পিড়াপিড়ি করলে রুমানা রাগ করত। বলত, এ বয়সে এরকম একটু আধটু করবে।

কিন্তু ইদানীং রম্মান স্কুলে না যেতে চাইলে রুমানা জোর করে নিয়ে যায়। অর্থাৎ বাহিরে কোন বিষয়ে রুমানা ইনভল্ব না ।

জহির চৌধুরী আগের চেয়ে ইচ্ছে করে রুমানাকে সময় কম দেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছেন রুমানা নতুন একটা সম্পর্কে জড়িয়েছে। তার নতুন উপন্যাসের কাহিনি তার নিজের জীবন কাহিনি। বিশেষ করে তার রুমানার।

কিন্তু জহির চৌধুরী এসব বিষয়ে কোন কিছু রুমানাকে জিজ্ঞেস করেন না। রুমানার ঘন্টার পর ঘন্টা বাহিরে থাকা তাকে বিচলিত করে কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয় না। নতুন উপন্যাসে অতি নিপুণভাবে রুমানার বিষয়গুলো তুলে ধরছেন জহির।

অল্প কিছুক্ষণ পরে তিনি কারণ জানতে পারেন। কেউ একজন বাসায় এসেছিলেন তিনি তা বুঝতে পারেন। লেখার ঘরের উত্তর পাশের দেয়ালের কর্ণারের নিচে মালবোরো সিগারেটের ফিলটারের কিছু অংশ উদ্ধার করেন। তার নিজের সিগারেটের এ্যাশ রাখার এ্যাশট্রেতেও আরও তিনটি ফিলটারের অংশ আবিষ্কার করেন তিনি। স্পষ্ট বুঝতে পারেন আগন্তক ব্যাক্তি বেশ কিছুক্ষণ অবস্থান করেছিলেন ।

জহির চৌধুরীকে বিচলিত দেখে রুমানা জিজ্ঞেস করেন, কোন সমস্যা?

জহির চৌধুরী স্বাভাবিকভাবে উত্তর দেন, নাতো?

রুমানা কথা না বাড়িয়ে বলে, তুমি ক্লান্ত। টেবিলে খাবার আছে খেয়ে নাও।

জহির চৌধুরী বলেন, ঠিক আছে।

Page No 3


চতুর্থ অংশ

আজ খুব সকালে রুমানা বের হয়ে যায়। জহির চৌধুরী ও রুম্মান তখনো ঘুমাচ্ছেন। কিন্তু রুমানা যখন বের হয় দরজার আওয়াজে তার ঘুম ভাঙে। রুমানাকে জিগ্গেস করতে পারতো কিন্তু করেননি। জহির চৌধুরী তার উপন্যাসের আর একটি প্লট আজ পেয়ে গেলেন। পরবর্তী প্লটে কি লিখবেন ভীষণ ভাবনায় ছিলেন। কিছুতেই মাথায় নতুন কোন ভাবনা আসছিল না।

বিছানা থেকে উঠে এক গ্লাস পানি খেলেন তিনি। হঠাৎ ডাইনিং টেবিলের উপর একটা চিরকুট পেল। রুমানার লেখা । লিখেছেন, জহির একটু আরলিয়ার বাহিরে গেলাম। তুমি আর রুম্মান ঘুমাচ্ছো বলে আর জাগিয়ে তুলিনি। রুম্মানের ক্লাসের সহপাঠীদের অভিভাবকদের সাথে আজকে গেটটুগেদার হবে। এজন্য যাওয়া। ফিরতে দেরি হবে।

 

জহির চৌধুরী ভাবে আজকে হলিডে । রুম্মানের স্কুল বন্ধ । তার মন চাচ্ছে বাহিরে যেতে। কিন্তু রুম্মানকে একা রেখে কিভাবে যাবে। সিদ্ধান্ত নেন রুম্মানকে সাথে নিবেন। নাস্তা টেবিলে রাখাই ছিল। জহির খেয়ে নেয়। কিছু পরে রুম্মানকে ডেকে তোলে ঘুমঘুম চোখে রুম্মান বলে, এখন ডাকলে কেন বাবা । আর একটু ঘুমাতাম।

 

- আমরা বাহিরে যাব । 

রুম্মান ঝটপট উঠে পড়ে । অনেক কৌতুহল নিয়ে জিগ্গেস করে, বাবা আমরা কোথায় ঘুরবো

- রিকশায় সমস্ত ঢাকা শহর ঘুরবো

- ও তাই । তবে রিকশায় যখন ঘুরবো, বিকেলে হলে ভালো হতো।

- কথা কম বলো। জলদি নাস্তা খেয়ে গুছিয়ে নাও

- ওকে বাবা

 

জহির চৌধুরী কফি কালারের পাণ্তাবি আর বেলবটম প্যান্ট, কলাপুরি ছ্যান্ডেল পরে রেডি হয়। রুম্মান টি শার্ট আর জিন্স পরে । বাবা ছেলে বের হয়।

রিকশায় ওঠে বসে। সকাল দশটা বাজে । শহরের সব কর্মজীবি মানুষের কাজে যাওয়ার তাড়া । ব্যান্ত রাস্তার প্রতিটি বাকে অসম্ভব জ্যাম । রিকশা যেন স্থির হয়ে আছে। এগুতে চায় না। অস্থির রুম্মান প্রশ্ন করে, আমরা

কোথায় যাচ্ছি বাবা?

- আগে কোন একটা রেস্টুরেন্টের সামনে নামবো । তারপর নাস্তা করে পার্কে বসব।

- পার্কে বসার জন্য তো সবাই বিকেলে যায় বাবা।

জহির চৌধুরী রু্মানের প্রশ্নের জবাব দেন না। কেননা রুমানার এই অস্বাভাবিক পরিবর্তন যে তার ভেতরে প্রভাব ফেলেছে তা তিনি স্পষ্ট অনুভব করছেন।

 

একটা রেস্টুরেন্টে বাবা ছেলে নাস্তা করেন। তারপর উত্তরার ৪ নং সেক্টরের লেক পার্কে এসে বসে। পার্কের ভেতরে দক্ষিণ পাশের শেষ মাথায় বিশাল রেস্ট্ররেন্ট । সাধারণত কপোত-কপোতীরা এখানে খাওয়া দাওয়া করে । মূলত বিনোদনের উদ্দেশ্যে এখানে তারা আসে। রুম্মান ওদিকটায় যেতে চায়। জহির চৌধুরী রুম্মানকে নিয়ে রেস্টুরেন্টের দিকে এগোতে থাকেন। রেস্টুরেন্টের কোল ঘেষে ছোট্ট কুলের বাগানটি জহির চৌধুরীকে আর্কষণ করে । কাছাকাছি যেতেই জহির আচমকা থমকে দীড়ান। এভাবে দাড়িয়ে যাওয়ায় রুম্মান প্রশ্ন করে, হঠাৎ দাড়ালে কেন বাবা । বাগানের দিকে চলো

 

- বাগান না দেখলে হয় না বাবা

রুম্মান আরও কৌতুহলী হয়ে ওঠে। বলে, কেন বাবা?

- এমনি ।

রুম্মান আর প্রশ্ন করে না। বলে, তোমার মন না চাইলে থাক।

জহির চৌধুরী হাফ ছেড়ে বাচেন। আগের স্থানে এসে বসেন। রুম্মানকে বসিয়ে রেখে রেস্টুরেন্টের দিকে আবার আসেন ।

থমকে যাওয়ার কারণ জহির চৌধুরী রেস্টুরেন্টের উত্তর পাশের জানালার ধারের টেবিলের একপাশে চেয়ারে বসা রুমানাকে দেখেছেন। পিছন থেকে দেখে জহির চৌধুরী নিশ্চিত চিনতে পারেন।

 

রুমানার সামনে টেবিলের অপার পাশে একজন যুবক বসা। যুবকটি বেশ পুরুষালি। সুঠাম দেহের যুককের চেহারায় যথেষ্ট মাদকতা । যেকোনো বয়সের নারীদের আর্কষীত করবার মতো চেহারা । জহির চৌধুরীর ভেতরে কোথাও কে যেন হামার দিয়ে আঘাত করছে। এরকম দৃশ্য দেখার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। রুমানা আর  যুবকটি এ ওর গায়ে খোচা দিয়ে খুনসুটি করছে। জহির চৌধুরী বেশিক্ষণ দাড়াননি। রুম্মান কে কোন রকমে বুঝিয়ে পার্ক থেকে বের হয়ে যান। রুম্মান প্রশ্ন করে, পার্ক থেকে বের হলে কেন বাবা?

 

জহির চৌধুরী কোন কথা বলেন না। রুম্মান আবার জানতে চায়, কিছু বলছ না কেন বাবা?

জহির চৌধুরী একটু বিরক্ত হয়ে বলেন, তুমি একটু বেশি কথা বল। বাবার মুখে এরকম বিরক্তিকর কথা শুনে রুম্মান বলে, ঠিক আছে আর কিছু জিজ্ঞেস করব না।

 

জহির চৌধুরী ছেলের মুখে পরিণত কথা শুনে হতবিহবল হয়ে পড়েন। তারপর রুম্মানকে কাছে টেনে আদর করে । কপালে চুমু খায়। বলেন, আজ আর না ঘুরি বাবা। আজকে মনটা খারাপ।

রুম্মান বুঝতে পারে বাবার কিছু একটা হয়েছে। তাই জিদ না ধরে বলে, হুম।

জহির চৌধুরী রিকশা ঠিক করে । বাসার অভিমুখে রওনা দেন।

Page No 4


পঞ্চম অংশ

সন্ধ্যায় বাসায় ফেরে রুমানা । তখন জহির চৌধুরী প্রকাশনার লোকদের সাথে আলাপে ব্যত্ত। রুমানা ওদিকটায় যায় না। সোজা নিজের রুমে প্রবেশ করে। ক্লান্ত রুম্মান ঘুমিয়ে ছিল। ছোটখাটো শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। রুমানা পোশাক ছাড়ছিলেন। ঘুমদ্ম চোখে রুম্মান জিজ্ঞেস করে সারাদিন কোথায় ছিলে আম্মু।

রুমানা হতচকিত হয়ে পড়ে । রম্মানের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে। আহলাদি রুম্মান বলে, জানো আম্মু রান্না করতে গিয়ে বাবার হাত পুড়ে গেছে।

রুমানা একটু বিস্মিত হয়। তার খুব খারাপ লাগে। এত সময় বাহিরে না থাকলেও পারত। লজ্জায় জহির চৌধুরীর ওখানে আর যান না। শুধু রুম্মানকে জিজ্ঞেস করেন, দুপুরে কি লাঞ্চ করেছ?

- সবজি খিচুড়ি আর ডিম ভাজা ।

রুমানা আর কিছু জিড্রেস করে না। রুম্মানকে এক গ্রাস দুধ গরম করে দেয়। তারপর রাতের খাবার রান্নায় কিচেনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

রাতে ডিনারে সারাদিন পরে প্রথম কথা হয় জহির আর রুমানার । রুমানা খাবার পরিবেশন করতে করতে বলে,

আমি দুঃখিত, জহির.

- কিন্তু কেন?

- না... আজ তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে।

- ঠিক আছে. আপনার ডিনার করুন.

- তুমি রেগে আছো নিশ্চয়।

- আরে না।

- আসলে সব অভিভাবকেরা এমনভাবে ধরলো যে ইচ্ছে থাকলেও আগেভাগে আসতে পারিনি ।

রুমানার ডাহা মিথ্যা কথা শুনে জহির অবাক বিস্ময়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তখন রুমানা বলেন, তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি।

জহির চৌধুরী একটু ঘুরিয়ে বলে, খাও। খাবার সময় কথা বলতে ভালো লাগে না।

রুমানা চুপ হয়ে যায়। রুম্মানের প্লেটে খাবার তুলে দেয়।

Page No 5


ষষ্ঠ অংশ

রুমানার এই সকল অনাকাজিফষিত আচরণ ক্রমশ জহির চৌধুরীকে ভাবিয়ে তুলছে। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না রুমানা এমনটা করতে পারে। ইদানীং কারণে অকারণে রুমানা মেজাজ হারিয়ে কেলেন। তার গোপন সম্পর্কের ব্যাপারে জহির যে ওয়াকিবহাল তা রুমানা জানেনা । তবে জহিরের ভুল হচ্ছে। স্বামী হিসেবে তার দ্বায়িত্ব রুমানার এই ভুল পথ থেকে কিরিয়ে আনা । কিন্তু তা জহির চৌধুরী করছেন না। ফলে রুমানা ধীরে ধীরে তার নতুন সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যায়।

 

রুমানার জীবনে দ্বিতীয় যে পুরুষের আর্বিভাব ঘটেছে তার নাম অন্তরীপ মাহমুদ । পেশায় ব্যবসায়ী । উচ্চ শিক্ষিত সূদর্শশ তরুণ অন্তরীপ মাহমুদ তার বাবার ব্যবসা দেখাশুনা করেন। অন্তরীপের বাবা একজন জাত ব্যবসায়ী। অর্থবৈভবের ভিতর বেড়ে ওঠা অন্তরীপ অনেকটা সহজসরল। রুমানাকে সে মনেপ্রাণে ভালোবেসেছে। রুমানা বিবাহিত জেনেও অন্তরীপ এ সম্পর্কে জড়িয়েছে। কিন্তু রুমানার ভাবনাটা সম্পূর্ণ বিপরীত । সে একঘেয়েমি জীবন থেকে একটু মুক্তির পথ খুজতে চেয়েছে । এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু অন্তরীপ মাহমুদ রুমানাকে সারাজীবনের জন্য পাশে চায়।

 

সেদিন রুমানা অন্তরীপকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করে । বলে, আমিতো তোমার সব শর্ত মেনেছি

- যেমন

- এই যে সুযোগ পেলে তোমাকে সময় দিচিছি।

- শোন, একজন নারীর সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস যেটা, তা আমি তোমাকে অনায়াসে দিয়ে যাচ্ছি।

- রুমানা আমি তোমার সবকিছুতে থাকতে চাই।

- আমিতো না করিনি

- তাহলে জহির চৌধুরীকে ভির্ভোস দাও।

রুমানার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে । অন্তরীপের এমন সিদ্ধান্তের জন্য রুমানা প্রস্তুত ছিল না। মুহুর্তের মধ্যে তার ভিতরে এক অজানা ঝড় বয়ে যায়। কি বলবে বুঝতে পারছিল না। রুমানাকে হঠাৎ অন্যমনোক্ষ দেখে

অন্তরীপ বলেন, 

-কোন সমস্যা?

- না না. ঠিক আছে. আমার এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। প্লিজ, আমাকে যেতে হবে। 

পরে কথা বলবো

 

অন্তরীপ বুঝতে পারেন রুমানা বিষয়টা সেভাবে গ্রহন করতে পারেনি । সেও বুঝতে পারছে না এ মুহুর্তে তার

আসলে কি বলা উচিত। চিন্তা করে রুমানা একটু একান্তে ভাবুক। তাই আর কোন কথা না বাড়িয়ে বলেন, না

সমস্যা ব্যস্ত থাকলে যেতে পারো ।

রুমানা কিছু বলে না। 

রুমানা কিছু বলেন না ।শুধু ধন্যবাদ জানিয়ে দ্রুত চলে যায়।

Page No 6


সপ্তম অংশ

অন্তরীপের এরকম ভাবনা রুমানাকে ভাবিয়ে তোলে। সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। কোন কাজে মন বসাতে পারছেন না। অন্তরীপকে সে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছে এটা সত্য কিন্তু জহিরকে ডিভোর্স দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব

না। তাছাড়া রুম্মানের জীবনটা তো মা হিসেবে সে নষ্ট করে দিতে পারে। নানাবিধ চিন্তা রুমানাকে গভীর সংকটে ফেলে দেয়।

কয়েকদিন ধরে রুমানা অন্তরীপ মাহমুদের সঙ্গে দেখা করেননি । এর মধ্যে অন্তরীপ অনেক বার ফোন করেছেন কিন্তু রুমানা তার কোন কল রিসিভ করেননি । এমন ফল অন্তরীপের কোন টেক্সটের জবাবও দেননি ।

রুমানা এই মুহুর্তে যে গভীর কোন সংকটে আছে জহির চৌধুরী তা স্পষ্ট বুঝতে পারেন। রুমানার এই একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে জহির কোন ধরনের হস্তক্ষেপ করেন না। না জানার অভিনয় করে নতুন উপন্যাসের প্লট বাড়াতে থাকেন। উপন্যাসের শেব দৃশ্য কেমন অবতারণা হবে জহির তা বুঝে উঠতে পারছেন না। তবে একটু অনুধাবন করেন শেষমেশ রুমানা আর তার একান্ত গোপন প্রেমিকের বিচ্ছেদ হবে ।

রুমানার এই তথাকথিত প্রেমিকের নাম জহির চৌধুরী জানেন না। সেজন্য তিনি একটা কল্পিত নাম দিয়েছেন। আর রুমানার নামটি তিনি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন।

রুমানা ধারনা জহির তার একান্ত গোপন সম্পর্কের কথা কিছুই জানেন না। তারপরও রুমানা ইদানীং জহির চৌধুরীর সামনে স্বাভাবিক হতে পারেন না। একসাথে একই বিছানায় রাত্রি যাপন করলেও বেশ কিছুদিন তাদের মধ্যে দৈহিক সম্পর্ক নেই। শারীরিক মিলনের ব্যাপারে বরাবরই রুমানার আগ্রহ বেশি ছিল। কিন্তু রুমানা এখন এই বিষয়ে কোন আগ্রহ দেখান না। জহির বিষয়টি অনুধাবণ করতে পেরে রুমানাকে কোন ধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলতে চান না।

সেদিন রাতে জহির রুমানার কাছে বিশেষ আবদার করেছিলেন কিন্তু সম্মতি না পেয়ে ভীষণ কষ্ট পান। প্রায় অনেক দিন পরে জহিরের এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করা রুমানার ঠিক হয়নি তা সে বুঝতে পারে। কিন্তু কেন যেন জহিরের এ আহবান তার আর ভালো লাগে না। তাই জহিরকে সে মিথ্যা বলে। বলে..

জহির পাশ কিরে ঘুমিয়ে পড়েন। রুমানার হঠাৎ চৈতন্য কেরে । ভাবে কাজটা ঠিক হয়নি। জহির শারীরিক মিলনের ব্যাপারে কখনো তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোন আবদার করেন না। ভুল বুঝতে পেরে রুমানা জহিরকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু জহির তখন অঘোরে ঘুমাচ্ছে। এত সুন্দর ঘুম রুমানা নষ্ট করতে চায়নি। তবে সারারাত রুমানার নিঘাহীন কাটে । তার এ মুহুর্তে কি করা উচিৎ সে বুঝতে পারে না।

Page No 7


অষ্টম অংশ

অনিচ্ছা সত্তেও রুমানা আবারও অন্তরীপ মাহমুদের সাথে ঘনিষ্ট হয়। ইদানীং সে সব বিষয়ে জহিরকে এড়িয়ে চলে । আচরণে এমন পরিবর্তন আনে যে, নানান কৌশলে জহিরকে বুঝায় সে রুম্মানের লেখাপড়া নিয়ে অনেক ব্যস্ত। কিন্তু জহির চৌধুরী নীরবে সব পর্যবেক্ষণ করে। বাসায় আবারও সেই অচেনা ব্যাক্তির আনাগোনা হচ্ছে তা

স্পষ্ট বুঝতে পারেন জহির । মাঝে মাঝে ভাবেন এ ব্যাপারে রুমানাকে কিছু জিজ্ঞেস করার কিন্তু তার ভেতর থেকে কে যেন নিষেধ করে।

আজ দুপুরে প্রকাশনা থেকে বাসায় ফিরছিলেন জহির । উত্তরার জসিম উদ্দিন রোডের মাঝামাঝি স্থানে এসে রিকশা ছাড়েন। বাসায় না গিয়ে বিশে এক বন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করার প্রয়োজন বোধ করেন । হঠাৎ রাস্তারঅপর পাশে রুমানাকে আবিষ্কার করেন । হাত ঘড়ির দিকে চোখ বুলিয়ে নেন। দুইটা ছুঁইছ্টুই। রুম্মানের স্কুল রেকের এখনো এক ঘন্টা বাকি। জহির বুঝতে পারেন এই অন্তরবর্তী সময়ে প্রতিদিন রুমানা তার তথাকথিত প্রেমিকের সাথে সময় কাটায়। জহির রুমানা ও তার কথিত প্রেমিককে অনুসরণ করেন।

রুমানা ও অন্তরীপ মাহমুদ বিএমডরিউ ব্র্যান্ডের গাড়িতে পাশের একটা রেস্টুরেন্ট পিজা হাট এ প্রবেশ করেন।

জহির চৌধুরী তাদেরকে অনুসরণ করে রেস্টুরেন্টের ভিতরে ঢোকেন। রুমানা ও অন্তরীপ মাহমুদ একটা বিশেষ

টেবিলে বসেন। জহির ঠিক বামপাশের একটা টেবিলে রুমানাদের কোল ঘেঁবে বসেন।

 

নিজেকে আড়ালে রেখে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। রুমানা ও অন্তরীপ মাহমুদ দুজনই চুপচাপ গন্তীর হয়ে

আছেন। জহির চৌধুরী বুঝতে পারেন তার পৌছানোর আগে তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কোন আলাপ হয়েছে যাতাদেরকে চিন্তিত করে তুলেছে। হঠাৎ অন্তরীপ বলেন,

 দেরি করছেন কেন?

অত্যন্ত বিরক্তিকর, রুমানা।

- আমি জানি কিন্তু এতক্ষণে আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারব না।

- আমি মনে করি আপনি কিছুই জন্য দ্বিধা বোধ করছেন.

- তুমি ভুল আঁটোরিপ। আমি গভীরভাবে এটি সম্পর্কে চিন্তা করেছি কিন্তু কোন পৌঁছতে পারে না সিদ্ধান্ত ধৈর্য ধরুন. নিশ্চয়ই অল্প সময়ের মধ্যে একটা ভালো খবর দিতে পারব

সময়

- না না. আমি বুঝতে পারছি না কেন তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না।

- আমি তোমাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করি, অ্যান্টোরিপ, কিন্তু আমি... সত্যিই জহিরকে ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারি না দয়া করে অপেক্ষা করুন এবং আমাকে সমর্থন কর।

- আচ্ছা ঠিক আছে. আপনি আপনার সময় নিন কিন্তু খুব বেশি সময় নেবেন না।

তাদের কথাবার্তা শুনে জহির চৌধুরীর সারা শরীর ঘামে ভিজে গেল। মাথায় অনেক এলোমেলো দাগ করে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। উপন্যাসের শেষ অংশের বিষয় মাথায় এল। আরো একটা মুহূর্ত সেখানে বসে থাকে না। তার শরীর খুব দুর্বল লাগছে। কোনোরকমে রেসেটমরান থেকে বের হয়ে রিকশা নিয়ে বাড়ি দিকে এগিয়ে গেল

Page No 8


নবম অংশ

রাতদিন অমানসিক পরিশ্রম করে নতুন উপন্যাস শেষ করে জহির । কিন্তু বিপত্তি বাধে উপন্যাসের নাম নিয়ে । কি নাম দেওয়া যায় ভাবে কিন্তু কোন নাম তার মাথায় আসে না।

কয়েকদিন পরে জহির বাসার ব্যলকনিতে বসে সিগারেট কুকাচ্ছিল। হঠাৎ একটা দৃশ্য তাকে আর্কবিত করে।

দুটি চড়ুই পাখি পাশের বাড়ীর এক কার্নিশে একজন অন্যজন থেকে দূরে অবস্থিত । পুরুষ চড়ুই পাখিটিকে অসুস্থ মনে হয় জহিরের। নারী চড়ুই পাখিটি তার কাছে আসে না। অথচ পুরুষ চড়ুই পাখিটি প্রানপনে চেষ্টা করছে পাশে যাওয়ার কিন্তু অসুস্থ বিধায় পারছে না। তার কাছে যাওয়ার, কাছে পাওয়ার আকুতি জহিরকে বিচলিত করে তুলে । হঠাৎ আর একটি পুরুষ চড়ুই পাখি নারী চড়ুই পাখিটার কাছে উড়ে আসে । ঠিক তখনই নারী চড়ুই পাখিটি তার পুরনো বন্ধু পাখিটিকে রেখে খুনসুটিতে মেতে ওঠে । কিছুক্ষণ পরে তারা উড়ে দূরে চলে যায়। অসুস্থ পুরুষ চড়ুই পাখিটি অসহায়ের মতো নীরবে দেখে ।

এই ঘটনার সাথে জহির চৌধুরী তার জীবনের মিল খুঁজে পায়। আর তার নতুন উপন্যাসের নামও ঠিক করে ফেলে । যেহেতু পাশের বাড়ীর দূরের কার্নিশে দুটি পাখির ঘটনার সাথে তার জীবনের অন্তমিল আছে তাই জহির নতুন উপন্যাসের নামকরণ করে " দূরের কার্নিশ "। আসলে জহির মনে করেন এরকম দুরের কার্নিশের ঘটনা

আমাদের সমাজের অনেকেরই জীবন চিত্র।

জহির ভীবণ অসুস্থ। সে মনে করে তার হাতে সময় কম। তাই কালক্ষেপণ না করে প্রকাশনীতে নতুন উপন্যাস

জমা দেয়। প্রকাশনীর ম্যানেজার সাদেক আহমেদ বলেন, স্যার আপনার নতুন উপন্যাসের বিষয়ে একটা

সাংবাদিক সম্মেলন করে পাবলিককে জানানো উচিৎ। আপনি অনুমতি দিলে আমি সব আয়োজন সেরে ফেলতে চাই।

- না..মি. সাদেক। উপন্যাসটি প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত আমি এটি গোপন রাখতে চাই।

কিন্তু স্যার, কেন? পাবলিকের ইমোশন না জাগালে বইটি সম্পর্কে আলোচনা কম হবে।

 

আমি জানি কিন্তু.. আমি চাই তারা এই উপন্যাসটি গ্রহণ করুক। আশা করি আপনি সাহায্য করবেন আমাকে

- অবশ্যই স্যার. কেন না?

- ঠিক আছে... বাই.. জহির চৌধুরী উঠে চলে গেলেন।

ম্যানেজার সাদেক আহমেদ অবাক বিস্ময়ে জহির চৌধুরীর চলে যাওয়া দেখেন।

জহির চৌধুরীর এরকম আচরণ সাদেক আহমেদকে ভাবিয়ে তোলেন । তৎ্ক্ষনাক তিনি রুমানাকে ফোন করেন।

- ম্যাডাম, আসালামু আলাইকুম

-জ্বি বলুন

 

ম্যাডাম, আজকে এইমাত্র স্যার প্রকাশনীতে এসেছিলেন এবং অল্প কিছুক্ষণ থেকে আবার চলেও গেলেন।

- তো..কি হয়েছে।

- ম্যাডাম, স্যারকে অসুস্থ মনে হলো । চেহারাটা খুবই বিমর্ষ লাগলো।

- এ অবস্থায় তাকে যেতে দিলেন কেন?

- আপনিতো জানেন, আমরা স্যারের উপর কোন কথা বলতে পারি না।

- হুম। ঠিক আছে।

রুমানা ফোন রেখে দিলেন। তার মধ্যেও দুশ্চিন্তা কাজ করতে লাগলো । জহিরের বাসায় ফেরার অপেক্ষায়

থাকল।

Page No 9


দশম অংশ

ক্রমশ জহিরের শরীর দুর্বল হতে থাকে । রুমানা বুঝতে পারেন জহিরের কোন সমস্যা আছে। এখন রুমানা অনেক বেশি সমাদর করে জহিরকে । তার জন্য জহিরের এ পরিনতি তা সে জানে না। তার ধারণা অন্তরীপের সাথে তার এ সম্পর্ক জহির জানে না। তার বিশ্বাস এটা জহিরের জানবার কথা নয়। এজন্য সে গোপন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে । একদিন রুমানা জহিরকে বলেন, তোমার ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ।

 

জহির একটু গাল্তীর্যের সঙ্গে বলেন, কেন?

- দিনদিন তোমার শরীরের কি অবস্থা হচ্ছে তুমি বুঝনা ।

জহির চৌধুরী বিন্দুমাত্র রুমানার কথায় কর্ণপাত করেননি ।তখন রুমানা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলেন, আমার কথা কি শুনছ?

-হুম।

- কিছু বলছ না কেন?

- আমি একদম ঠিক আছি। কেন আমরা এই মূর্খ বিষয় নিয়ে অকারণে কথা বলছি?

জহিরের এরকম অবজ্ঞাসূচক কথা শুনে রুমানা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে । বলেন,বলল, এটা কি মূর্খ?

- আমি তাই মনে করি.

- ঠিক আছে... তোমার যা খুশি করো।

রুমানা রাগ করে পাশের ঘরে চলে যায়।

 

রুমানা চলে যাওয়ার পরে জহির চৌধুরী প্রকাশনীতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেন। বইয়ের কি অবস্থা তা জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। তিনি বুঝতে পারেন তার হাতে সময় খুব কম। নতুন উপন্যাসের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। অসুস্থ শরীরে জহির বেরিয়ে পড়েন।

এদিকে রুমানা ভুল বুঝতে পারেন। চিন্তা করেন অসুস্থ জহিরের সাথে এমন রুঢ় আচরণ না করলে ভালো হতো । দ্রুত কিচেনে গিয়ে এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে জহিরের লেখার রুমে চলে আসেন । জহিরকে না পেয়ে ভীষণ কষ্ট পান। কিছুটা মানসিক দুশি্তায় অস্থির হয়ে ওঠেন। এই ভরদুপুরে কোথায় গেল বুঝতে পারেননি । মোবাইলে একাধিক বার কোন করেও জহিরের সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি । রুমানার কোন কল জহির ধরেননি।

প্রকাশনী থেকে জহির বেশ রাত করে বাসায় ফেরেন। রুমানা দীর্ঘক্ষণ কোথায় ছিল জানতে চাইলে জহির কোন উত্তর দেননি । রুমানা একরকম বিরক্ত হয়ে ঘুমোতে চলে যান। জহির লেখার রুমে একান্তে বসে লেখার কাজে মনোনিবেশ করেন।

রাতের শেৰ প্রহরে রুমানার ঘুম ভেঙে যায়। তখন বাহিরে অঝোরে বৃষ্টি, সেইসাথে ঝড়ো বাতাস। ঠান্ডা হিমেল হাওয়ার অনুভূতি তার অঙ্গে নতুন অনুভূতির দোলা দেয়। জহিরকে একান্তে পাওয়ার আকুতি জাগে । জানালার রেশমি পর্দার দোল খাওয়ার ছন্দে শরীরে এক অজানা আবেশ মাতম তোলে । সব অভিমান ভুলে স্বল্প বসনে দেহের উন্মুক্ত অংশে শীতল পরশ তাকে আদিমতায় মগ্ন করে তোলে । ধীর পায়ে জহিরের সাহিত্য চর্চার রুমে প্রবেশ করেন রুমানা ।

জহির টেবিলে মাথা নিচু করে ঘুমিয়ে পড়েছেন মনে হয়। কমল পরশে তাকে জড়িয়ে ধরেন রুমানা । কিন্তু নিথর জহির রুমানার শীতল কমল পরশে জেগে ওঠেন না। রুমানা অনুযোগের সুরে বলেন, কি হলো তোমার। অনেক ক্লান্ত বুঝি।

কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে একটু জোরে ধাকা মারেন রুমানা । নিথর জহির হঠাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কিংকর্তব্যবিমুড় রুমানা গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে বলে ওঠেন, এই কি হলো তোমার । এমনতো কথা ছিল না।

Page No 10


একাদশ তম অংশ

জহিরের মৃত্যুর পরে রুমানা একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। কেন জহির এভাবে তাকে অকালে ছেড়ে চলে

গেলেন তার জবাব খুজতে শুরু করেন রুমানা । কিন্তু কোন উত্তর খুঁজে পান না। অবশ্য ডাক্তার শেষ বারের

মতো জহির চৌধুরীকে পরীক্ষা করে বলেছিলেন অত্যন্ত মনোবেদনায় হার্টফেল করে তার মৃত্যু হয়েছে।

 

রুমানা উত্তর খুঁজে পেয়েছিলেন জহিরের শেষ উপন্যাস " দূরের কার্ণিশ " প্রকাশিত হবার পর। এ উপন্যাসের জন্য মরোনত্তর বাংলা একাডেমির সাহিত্য পুরস্কার পান জহির চৌধুরী । প্রকাশনা সংস্থার উদ্যোগে বিশেষ সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। যেহেতু জহির চৌধুরী পরলোকগত, রুমানাকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ করা হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতে উপন্যাসের ঘটনাবলী সংক্ষিপ্ত আকারে আলোচনা করেন আলোচকগণ। কেন উপন্যাসের নাম " দূরের কার্নিশ " রাখা হলো তার স্বার্থকতা নিয়েও আলোচনা হয়।

 

আলোচনা শুনতে শুনতে রুমানা স্মতিকাতর হয়ে পড়েন। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারেন তার গোপন সম্পর্কের ব্যাপারে সম্পূর্ণ অকিবহাল ছিলেন জহির। আলোচনা অনুষ্ঠানে সকলেই সকলের মতো ছিলেন। কিন্তু রুমানা ছিলেন এক বিচারিক আদালতে । তার বিবেকের কাঠগড়ায় নিজেকে বারবার প্রশ্ন করে চলেন । অনুষ্ঠান শেষে সবাই সবার মতো করে বিদায় হন। কিন্তু রুমানা এক সঙ্গীহীন উদবাস্তুর মতো উদ্দেশ্যহীন ভাবে বের হন। রাস্তায় এসে দেখেন অন্তরীপ মাহমুদ তার জন্য অপেক্ষা করছেন। রুমানা সেদিকে না গিয়ে অন্যদিকে চলতে শুরু করেন। অন্তরীপ পিছন থেকে ডাক দিলেও রুমানা কোন ভুক্ষেপ না করে বাসার অভিমুখে রওনা দেন।

 

গভীর রাত পর্যন্ত রুমানা " দূরের কার্নিশ " পড়েন। একেবারে শেব অঙ্কে এসে কিছু কথা তাকে বিচলিত করে তোলে । লেখা আছে, " অধিকাংশ মানুষেরই হৃদয় জগতে কার্নিশে এরকম পাখি খেলা করে। বিবেক ও ভাবাহীন পাখিরা মুহুর্তে মুহুর্তে সঙ্গী বদলায় । কিন্তু মানুষেরা তা কেন করে। হয়ত তার সোনার মোহর একসময় স্বস্তা মাটির মোহরের মতো মূল্যহীন হয় বলে।

রুমানা আর পড়তে পারেন না। জলে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে উপন্যাসের পাতায় পাতায় জহিরের ছবি ভেসে

ওঠে।

Page No 11