গত কয়েকদিন থেকে অঝোর ধারায় বেশ বৃষ্টি হলো, আজ মেঘশূণ্য নীল আকাশে সূর্যটা তার দাপট দেখাতে ব্যস্ত, ঘাম ঝরা তাপে চারদিক খাঁ খাঁ করছে। বিদ্যুতের তারে বসে দু'একটি কাক খাদ্যের খোঁজে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে অতি সন্তর্পণে।
এমনি এক অলস সময়ে অফিসে, মার্বেল পাথরের মেঝের উপর রিমুভেবল চেয়ারে বসে হঠাৎ করেই, জীবনের হিসেব কষতে বসেছেন রফিক সাহেব।
চোখ তার উপরের দিকে , ছাদের নীচে ফ্যানের পাখাগুলো, যেনো ঘুরছে তার জীবনের মতোই। টেবিলের উপর কাগজের আলগা পাতাগুলোর মাঝেমাঝেই উড়ার ব্যর্থ চেষ্টা, অপলক তাকিয়ে দেখেন রফিক সাহেব, মনে মনে ভাবেন আর হাসেন, সত্যিই কাগজের পাতাগুলোর মতোই আমার জীবন, উড়তে চাইলেও ডানা মেলা যায় না, সময়ের সাথে সাথে কখন যে ডানা কেটে গেছে, পায়ে পড়েছে দায়িত্ববোধের শৃঙ্খল, বুঝতেই পারেননি ।
ইদানিং জীবনটাকে বেশ পানসে লাগে তার। তারুণ্যের সেই স্বাদ, সেই উচ্ছ্বলতা কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে সব। প্রতিদিনের সেই একই কাজ, ঘুম থেকে উঠা, গোসল সেরে খেয়ে নিয়েই ঘুণেধরা দেহটাকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বার্নিশ করে, আয়রন করা শার্ট প্যান্ট পড়েই সকাল ন'টায় অফিসে দৌড়,,,,,
আবার বিকেলে বাসায় ফেরা, আবার সেই একই নিয়মে চলা, মাথার উপড়ে ঘুরন্ত ফ্যানের মতোই। মাঝেমাঝেই হাঁফিয়ে উঠেন তিনি। একঘেয়েমি জীবন, কার বা ভালো লাগে!
ইচ্ছে করে তার, ব্যস্ততার দেয়াল ভেঙ্গে উড়াল দেয় পাহারের দেশে কিংবা হারিয়ে যায় সাগর পাড়ে। ইচ্ছে করে বর্ষার জলে ভিঁজতে, পূর্ণিমার রাতে নদীর ধারে ছোটছোট ঝোপঝাড়ের মাঝে জোনাকিপোকার সাথে খেলতে। ইচ্ছে করে শেষ বিকেলে তেপান্তরে গোধুলির রঙে রঞ্জিত হতে। কিন্তু শত ব্যস্ততায় তা আর হয়ে উঠে না।
অতিতের স্মৃতিগুলো যেনো আজ মরিচাধরা তালা ভেঙ্গে, ধুলোবালি সরিয়ে বদ্ধ ঘরের আঁধার কেটে, প্রভাতের প্রথম আলোর মতোই উঁকি দিচ্ছে মগজের ভিতর। তার মনে পড়ে প্রথম যৌবনের কথা, মনে পড়ে প্রথম প্রেমের কথা, ভালোবাসার কথা।
ঋতু নামে মেয়েটাকে প্রথম দর্শনে তার ভালো লেগে যায়, একটু একটু করে কাছে আসা, তারপর থেকে একাকীত্বতা ঘুঁচে তার জীবন হয়ে উঠলো স্বপ্নের বাগান, সেখানে ফুল ফুটতো সারা বছর ধরে , বসন্তের ধার ধারতো না কোকিল, প্রজাপতি ফড়িংয়ের আনাগোনা লেগেই থাকতো সেখানে।
তার মনে পরে, সময়ে অসময়ে বৃন্দাবনের সেই মেহগনি গাছের নিচে বসে, ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়ার কথা, মনে পরে ভাড়া করা রিক্সায় পুরো শহর চষে বেড়ানোর কথা। একসাথে সিনেমা দেখার কথা। আরও কতো কি! স্মৃতির আয়না যেনো চকচক করছে চোখের সামনে।
দেখতে দেখতে কয়েকবছর কেটে গেলে। ঋতুর সাথেই তার বিয়ে, সে অনেক কাহিনী,, তবুও তারা বেশ ভালো ছিলো, সংসারে সূখের কোন কমতি ছিলো না, বিয়ের পরের বছরই তাদের সংসার আলো করে আসলো এক রাজকন্যা। প্রায় প্রতিদিনই তারা বেড়াতে যেতো, আগের মতোই, বউয়ের চাকুরী হলো,,, দিনগুলো ভালোই কাটছিলো তাদের। পুরাতন স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে বেশ উৎফুল্ল বোধ করেন রফিক সাহেব।
হঠাৎ একটা ফোন এসে তার স্মৃতি বিচ্ছেদ ঘটায়, দীর্ঘঃশ্বাস আসে বুক ফেটে।
কতদিন বেড়ানো হয় না, চার দেয়ালের গন্ডি পেড়িয়ে, জীবন অতিতকে ডাকে হাতছানি দিয়ে, কিন্তু সেতো আর ফিরে আসার নয়।
বউয়ের সাথে সম্পর্কটাও যেনো আগের মতো আর নেই, মাঝেমাঝে মনে হয়, যাত্রাপালার নায়ক নায়িকার মতো কৃত্রিম মুখোশে চলছে দাম্পত্যজীবন।
তারও হয়তো ইচ্ছে করে বন্দী জীবনে সামান্য মুক্তির স্বাদ পেতে, সমস্ত শৃঙ্খল ভেঙ্গে দূরে কোথায় চলে যেতে, যেখানে থাকবেনা ব্যস্ততা, একঘেয়েমিতা, থাকবে শুধু অনাবিল সূখ।
কিন্তু সেও চাকুরীর ব্যস্ততার কারনে ক্লান্ত শরীরে অফমুডেই থাকে বেশিক্ষণ, তেমন একটা সাংসারিক কথাবার্তা ছাড়া অন্যকিছু আর নেই।
রফিক সাহেব ভাবেন, আচ্ছা সত্যিই কি আমাদের সম্পর্কের বন্ধন আগের মতোই আছে, নাকি দিনকে দিন আলগা হয়ে যাচ্ছে, পুরাতন রেভিনিয়্যু ডাকটিকিটের মতো। হতাশায় ভোগেন রফিক সাহেব, জীবনের যে সময়গুলো ছিলো সূখের পরতে পরতে সাজানো,
সেই সময়গুলো আজ রেললাইনের মতো সমান্তরাল, পাশাপাশি চলা,অথচ ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, অসহ্য, বিষাক্ততায় ভরপুর।আসলে জীবন কি এরকমই, শুধু ভাবতেই থাকেন রফিক সাহেব। ঘড়ির কাঁটার ঢংঢং আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পান তিনি। পাঁচটে বাঁজে, ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে আবার সেই জীবনের পথেই পা বাড়াতে হয়, হয়তো তার বাকি জীবনটাও কেটে যাবে এমনিভাবে,,,,
Page No 1