গ্রামের নাম গোপালপুর। মনোরম পরিবেশ। গ্রামের পূর্ব পাশে বিশাল ফসলের মাঠ। রবি শস্যসহ ধান পাট সবই চাষ হয়। বর্ষায় চারদিক পানি থৈ থৈ করে। শাপলা শালুক ও সব ধরনের মাছ বিলে পাওয়া যায়। উত্তর দক্ষিণে বিভিন্ন গ্রাম। পশ্চিম পাশদিয়ে উত্তর-দক্ষিণ মুখি বয়ে গেছে একটা খাল। এই খালটিই একসময়ের হারিয়ে যাওয়া কালী নদী। যৌবনে এর বুকচিরে লঞ্চ, স্টিমার চলত। এ অঞ্চলের বর্তমান বাসিন্দারা তা দেখেনি। এমনকি এ খবরও অনেকে জানে না। শুধু দেখে একটা গভীর খাল। খালের দু'পাড় ঘেষে হিন্দু-মুসলমানের বসবাস। পূর্ব পাড়ে কালী ঠাকুরের বাড়ি। তিনি ঠাকুর সম্প্রদায়ের লোক হলেও পুরোহিতগিরি করতেন না। তাঁর পরিবারটি ছিলো বেশ সচ্ছল। অনেক জমিজমা ছিলো। বাবা মা অনেক পূর্বেই চলে গেছেন ইহলোক ছেড়ে। ছিল একটা ছোট ভাই সেও সংসার পাতার পূর্বে কলেরা মহামারিতে স্বর্গলোকে বিদায় নিয়েছে। কালী বাবুর দাম্পত্য জীবন যুগ পার হলেও নিজ সন্তানের মুখ দেখতে পারেননি। অবশেষে পনেরো বছর পর এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। আদর করে নাম রাখেন চারুবালা।
দেখতে দেখতে চারুর বয়স বিশ পার হয়। বিয়ের তেমন উপযুক্ত কোনো প্রস্তাব আসে না। কালী বাবু খুব চিন্তিত। তিনি ভাবেন,
আমার একমাত্র কন্যা, আমরা জাতে হাড়ে কুলিন। ধন সম্পদ প্রতিপত্তি যা হোক মোটামুটি আছে। আমার চারুও তো দেখতে কত সুন্দর। উচু স্বাস্থ্যবান সুন্দরী, কোমর পর্যন্ত কালো চুল, ভাসা ভাসা চোখ, কি না আছে চারুর! কিন্তু বিয়ের প্রস্তাব আসে না কেনো!
নদীর জোয়ারের মত যৌবন জোয়ারও আসে বেগবান হয়ে। কিন্তু স্থায়িত্ব হয় কম। চব্বিশে পা রাখা চারুর ভিতরে নানা ভাবনা চিন্তা। চঞ্চলতা সাজ- গোজ এখন আর আগের মত ভালোলাগে না। সারাক্ষণ সংসারের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকে। জীবন বোধের কথা একেবারে মাথায় নেই। এহেন ….
Page No 1
পরিস্থিতিতে পরমেশ্বরের অসীম কৃপায় কালী বাবু ফরিদপুর এলাকার স্ব সম্প্রদায়ের একটা ছেলের সন্ধান পান। তার সাথে যোগাযোগ করে চারুর বিয়ে স্থির করেন। যথারীতি শুভ দিনে বাজি-বাজনা বাজিয়ে বিয়ের আয়োজন করেন। সাত গ্রামের লোকজন নিমন্ত্রণ করেন। ব্যাপক খাওয়া- দাওয়ার আয়োজনের মধ্যে দিয়ে বিয়ের কার্য সম্পাদন করেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দূর পথের কথা চিন্তা করে; চারুকে শ্বশুর বাড়ি না পাঠিয়ে নিজ বাড়িতে বাসর রাত উদযাপনের সু-ব্যবস্থা করেন।
অনেক দিনের দুঃচিন্তা লাঘবে স্বস্তিবোধ করেন কালী বাবু। তিনি লোক লজ্জার তোয়াক্কা না করে নিজে গিয়ে বাসর ঘরের পরিবেশ পরিস্থিতি দেখেন। এবং খুবই তৃপ্ততা অনুভব করেন। আল্পনা আঁকা ঘরের মেঝে, নিম কাঠের পালঙ্ক, নানা রঙের সুবাসিত ফুলের সৌরভ, বড় পলিতার লণ্ঠনের আলোয় বাসর ঘর ঝলমল করছে। এরপর ধর্মীয় রীতি অনুসারে নববধূ চারুবালা সুসজ্জিত হয়ে বাসর ঘরে প্রবেশের পূর্বে বাবা-মাকে প্রণাম করতে আসে। কালী বাবুর চোখ পড়ে কন্যার দিকে। তিনি ভাবেন,
এই আমার সেই অন্ধের যষ্টি। কাঙ্খিত ধন ছোট্ট চারু। বহু বলা-বলি, দেখা-শোনার পর ভগবান যাকে দয়া করে দিয়েছিলেন। ছোট বেলায় বেশি সময় উলঙ্গ থাকতে যার পছন্দ ছিলো। সারা দিন শুধু দুষ্টমি করতো। সে এখন নববধূ!
হঠাৎ কালীবাবুর স্বরণে আসে নমসুদ্র পাড়ার অমূল্য মাষ্টার মহাশয়ের কাছে শোনা কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাবুলিওয়ালা গল্পের খুকির কথা। তার চারু খুকিও বড় হয়ে বাসর ঘরে যাচ্ছে। এই আনন্দে কালীবাবু একেবারে ছেলে মানুষের মত কেঁদে অশ্রু সজল নয়নে চারুর মাথায় হাত রেখে আর্শিবাদ করেন।
প্রতিবেশি বৌদিরা, ঠাকুর মা, দিদি মায়েরা দল বেঁধে চারুকে বাসর ঘরে নিয়ে সুসজ্জিত পালঙ্কে বসান। ইতিমধ্যে নতুন জামাই হরিপদ বাসর ঘরে প্রবেশ করে। চারুবালা বিছানা থেকে উঠে প্রাণোনাথ স্বামীর পদযুগল প্রথমে ভিজে গামছা দিয়ে মুছে দেয়। পরে নিজের লম্বা কালো চুল দিয়ে তার পা মোছার পর হাত ধরে নিয়ে পালঙ্কে বসায়। শুরু হয় নব দম্পতিকে ঘিরে হাসি তামাশা, গল্প-আনন্দ! রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে একে একে সবাই চলে যায় বাসর ঘর ছেড়ে।
অচেনা অজানা দুই যুবক-যুবতী একই পালঙ্কে পাশাপাশি বসে আছে। কোনো কথা নেই, নেই নড়া-চড়া, একদম চুপচাপ। সাড়াশব্দও হারিয়ে গেছে যেনো রাতের গভীরতায়। প্রকৃতিও নিরব নিস্তব্ধ। সহসা নব বধূর দৃষ্টি পড়ে প্রাণোনাথের দিকে। ঘুমের ঘোরে তার শরীর ঢুলুঢুলু করছে। একটা বালিশ তার পিছনে হেলান দেয়ার জন্য রাখতে গিয়ে চোখ পড়ে পালঙ্কের পাশে রাখা বড় আয়নার দিকে। চারু নিজে নিজেকে চিনতে পারছে না। এতো সেজে গুজে সে কি মধুমালার বেশে পরী রাজ্যের মদন কুমারের পাশে বসে আছে! নাকি নতুন দেবতার সন্ধান পেয়ে তাকে নিয়ে স্বর্গলোকে অবস্থান করছে।
চারদিকে তাজা ফুলের মৌ মৌ গন্ধ। রকমারি ফুলের সাজ। মেঝেতে চকচকে আল্পনার প্রলেপ। ঘরের সবকিছু নতুনের মত চকচকে ঝকঝকে। পালঙ্ক যেনো নিজে নিজেই দোল খাচ্ছে। পাশে হেলে বসা রাজকুমার হরিপদ বাবু। কি সুশ্রী! কালো কোঁকড়ানো চুল, গোঁফ-দাড়ি বিহীন মুখ- মন্ডল। সু-উচ্চ টানা নাকটা দিয়ে মুখমন্ডলকে দুই ভাগ করে রেখেছে। এক পাশ দেখা যাচ্ছে দুধে আলতা মিশানো মসৃন মুখশ্রী। না জানি মহাবীরের মুখ মন্ডলের অপর পাশ কত সুন্দর। হালকা হলুদ রঙের পাঞ্জাবীর উপর গলের ফুলমালা বাহু পেশীতে মিশে পেশীর বলিষ্ঠতা অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এতক্ষণে চারুর কানে ভেসে আসে,
একটু জল খাবো!
ঘরের এক কোনে রাখা জলের কলস হতে এক গ্লাস জল এনে প্রাণোনাথের হাতে দেয় চারু। জল খাওয়ার সময় দু'এক ফোটা জল স্বামীর গন্ডদেশের ঠিক নিচে গড়িয়ে পড়ে। চারু শাড়ির আঁচল দিয়ে জল মুছিয়ে দেয়। হরিপদ তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। এই হাসির মাঝে চারু নিজেকে হারিয়ে ফেলে। মূহুর্তে দীর্ঘ ক্লান্ত বুভুক্ষ পথহারা পথিক বেশে হরিপদর দু'বাহু জড়িয়ে ধরে। হৃদয়ে আশ্রয় দেওয়ার জন্য টেনে নিয়ে নববধূকে বুকের সাথে স্পর্শ করার মুহুর্তে বাইরে একটা টং টং শব্দ বেজে উঠে।
শব্দটা কোথায় কেনো হলো চারু তা বুঝতে পারে না। সে ভাবে, এটি বাহিরের কোনো শব্দ। না কি বহু প্রতিক্ষিত প্রাণ প্রিয় দেবতাকে মন মন্দিরে পাওয়ার শুভ ঘন্টা ধ্বনি!
এতক্ষণে হরিপদ অর্ধাঙ্গিনী চারুবালার হাত দুটি নিজ হাতে সরিয়ে দেয়।
দেখি-
বলে পালঙ্ক থেকে নামে। দরজা খুলে বাহিরে যায়। যাবার সময় বাইরে থেকে দরজাটা আওজায়ে রেখে চলে যায়। স্বামী কোথায় গেলো। কেনো গেলো! কখন আসবে নববধূর কিছুই জানা হলো না!
চারু শুধু অপেক্ষার মালা গেঁথেই চলেছে। রাতের শেষ প্রহর। দিনকানা পাখিরা ডাকছে। চারুর খেয়াল নেই। গভীর ভাবনায় ভাবজগতের সাগর তলে কি যেনো সে খুঁজতে ব্যস্ত। এর কিছুক্ষণ পর মুসলমান পাড়ায় মসজিদের আজানের ধ্বনি। মোরগের ডাকে প্রভাত ফিরে আসে বসুন্ধরায়। এই সব সাড়া শব্দে চারুর চেতন ফিরে আসে।
তাইতো! সকাল হয়ে গেছে। আমার প্রাণোনাথ তো ঘরে এলোনা। সে কোথায়...!
চারু বের হয়ে উঠানে গিয়ে চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে! চিৎকার শুনে বাবা-মা প্রতিবেশী সবাই ছুটে আসে। চারু অচেতন! কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। সবাই হতবাক। মাথায় তেল জল ঘষে। কিছুক্ষণ পর চারুর জ্ঞান ফিরে আসে। সবিস্তারে রাতের ঘটনা খুলে বলে।
সাথে সাথেই পাড়া-গ্রাম হতে গ্রামে খবর ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু হরিপদকে আর পাওয়া গেলো না! কালী ঠাকুরের নতুন জামাই হরিপদ ঠাকুরকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে হারিয়ে গেছে। কোনো দিনই আর জামাই হরিপদর সন্ধান পাওয়া যায়নি। কেউ দেখেনি বা শোনেনি হরিপদ বেঁচে আছে না মরে গেছে! চারু মাঝে মাঝে লোক লজ্জা, চিন্তা ভাবনায় অসুস্থ হয়ে পড়ে। মন্দিরে পূজা আরতি ভক্তি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। দেবতার কাছে সে জানতে চায়,
ভগবান তুমি বলো! আমি সধবা না বিধবা?
দেবতার কাছে তার প্রশ্নের উত্তর পায় না। তবুও তাঁদের প্রতি চারু ভক্তিপূর্ণ পূজা অর্চনা বন্ধ রাখে না। তার আশা পূজা অর্চনায় খুশি হয়ে একদিন দেবতা তার প্রশ্নের জবাব দিবেই দিবে! কালী বাবুরও মনও ভেঙ্গে গেছে! পূর্বের মত এখন আর তিনি শালিশ বিচারে যান না। মন্দির মন্ডপের দিকেও তেমন খেয়াল নেই। এক পর্যায়ে সংসারের কাজেও মন বসে না। এভাবেই চলতে থাকে বছরের পর বছর।
একই গ্রামের মুসলমান পাড়ার প্রভাবশালী মাতব্বর বাছের শেখ। লেখাপড়া তেমন না জানলেও জমি জমা আছে ধানী-পানি গৃহস্থ্য। তিনটা ছেলে। মেজো ছেলের নাম ছামাদ। ছামাদ বাংলা, ইংরেজী লেখাপড়ার সাথে আরবী ধর্মীয় বিদ্যাও কিছুটা শিখেছে। কৃষি কাজ বা সংসারের অন্য কোনো কাজের প্রতি তার উৎসাহ নেই। সারাক্ষণ হয়তো মসজিদে না হয় কালী তলায় আড্ডা দেয়। সময় হলে বাড়িতে শুধু খেতে আসে। এই সব আচরণে বাবা-মাসহ আপনজনের নিকট অনেক সময় গাল-মন্দও শুনে
Page No 2
ছামাদ। কিন্তু তাতে ছামাদের পরিবর্তন আসে না। এ সব কথা সে কর্ণপাত করে না।
একদিন সকালে বাবা, ছামাদকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে। মাঠে কৃষি কাজে সহযোগীতার জন্য যেতে বলেন। ছামাদ তাতে রাজি হয় না। বাবা তাকে প্রহার করে। এবং অশ্রাব্য ভাষায় গালি গালাজ করে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেন। ছামাদ উপায়হীন হয়ে মনের কষ্টে বাড়ি থেকে বের হয়। ভাবতে থাকে কোথায় যাবে কি করবে। হাঁটতে হাঁটতে মনের অজান্তেই পৌঁছে যায় চিরপরিচিত কালীতলার মন্ডপে। কালীতলার বৃহৎ বট বৃক্ষের শিকড়ে হেলান দিয়ে চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভেঙ্গে চেতনায় ফিরে আসে। পেটে ক্ষুধার যন্ত্রণা! মাথায় নানা দূর্ভাবনা! ছামাদ দিক ভুলো নদীর রুইমাছের মত ডাঙ্গায় বটবৃক্ষের মূলে পড়ে থাকে। দিন চলে যায়; আসে মায়াবি সন্ধ্যা। চারু ও তার মা কালীতলার মন্ডপে নিত্য দিনকার আরাধ্য দেবতার পূজা দিতে আসে। চারুর চোখ পড়ে বট গাছের শিকড়ে। দেখে কে যেনো পড়ে আছে। জীবিত না মৃত দূর হতে তা বোঝা যায় না। তারা দু'জনই এগিয়ে যান। দেখেন রুক্ষ সুক্ষ বেশে শুয়ে আছে মুসলমান পাড়ার ছামাদ শেখ। চারুর মা তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করে,
তোমার এই অবস্থা কেনো?
ছামাদ কথা বলে না।
মা-মেয়ে দু'জনই তাকে বাড়িতে যাওয়ার অনুরোধ করে। বেশ কয়েক বার বলার পরও ছামাদ তাদের কথায় কর্ণপাত করে না। তারা চলে যায় পূজাকার্য সমাধা করতে। পূজা দিয়ে ফিরে এসে দেখে ছামাদ সেভাবেই
পড়ে আছে। নারীর মনের মাঝে মমতার যে দেবী বাস করে; সেই মূহুর্তে সে ধর্ম ভুলে যায়! চারু ছামাদের হাত ধরে! স্বজোরে টান দিয়ে দাঁড় করিয়ে বলে-
তোমাদের বাড়ি না যাও, চলো আমাদের বাড়ি যাবে! ছামাদ আর কোনো অমত না করে চারুদের বাড়ি যায়। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে কালী বাবুকে ছামাদ সব ঘটনা খুলে বলে। রাতে ঠিক-ঠাক থাকা- খাওয়ার ব্যবস্থা হয়। পরদিন সকালে কালী ঠাকুর বাছের শেখের বাড়ি যায়। তাঁকে ছামাদের ঘটনা বিস্তারিত বলেন। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয় না। ছামাদ মিয়ার বাবা-মাসহ পরিবারের সবাই সাফ জানিয়ে দেন, ছামাদের কোনো দায়ভার আমাদের নেই। সে বড় হয়েছে। কোথায় থাকবে, কোথায় যাবে, কি খাবে, মরবে না বাঁচবে! এসব নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথা নেই।
এসব কথা শুনে কালী ঠাকুর মনে কষ্ট নিয়ে বাড়ি ফিরেন। পথিমধ্যে ভাবতে থাকেন,
ভগবানের কি লীলা! শত চাইলেও কাউকে কাউকে দেন না। আবার যাকে দেন সে রাখতে চায় না। দুঃছাই করে তাড়িয়ে দেন।
এই ভাবনায় বিভোর হয়ে কালী ঠাকুর বাড়িতে পৌঁছেন। ছামাদসহ পরিবারের সকলের সাথে বসে ছামাদ মিয়ার বাড়ির কথোপকথোন বর্ণনা করেন। এতে উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে চুপ করে বসে থাকে। সহসা কালী বাবু স্ত্রী রুকিনী দেবীকে বলেন,
শোনো চারুর মা? ছেলে সন্তানের বাবা-মা তো আমরা হতে পারিনি।
তারপরও যখন ভগবানের মন্ডপ হতে ছামাদকে নিয়ে এসেছো। তিনিই দয়া
করে ছামাদকে আমাদের ছেলে হিসেবে দিয়েছেন। আজ হতে ছামাদ আমাদের ছেলে! ও এই বাড়িতে ছেলে হিসেবে থাকবে।
কালী বাবুর এই কথায় সবাই একমত। ছামাদ মিয়া কালী ঠাকুরের ছেলের পরিচয়ে থাকে।
শুরু হয় ভূমি জরিপ কাজ। কালী বাবু ছামাদ মিয়াকে সাথে নিয়ে জমি- জমার কাগজ পত্রাদি যাচাই বাছাই করেন। ছামাদের সাথে চারুর কোনো কথা হয় না বললেই চলে। চারু সদা সর্বদা মনের মধ্যে গভীর ভাবনা চিন্তা নিয়ে পূজা-অর্চনায় ব্যস্ত থাকে। এক সন্ধ্যায় হঠাৎ হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে কালী বাবুর মৃত্যু হয়!
বাবা হারা চারু আরো অসহায় হয়ে পড়ে! মন মানসিকতা ভেঙ্গে যায়। ছামাদ ধর্মীয় নীতিকথাসহ অনেক সান্তনার বাণী শুনিয়ে চারুকে বুঝিয়ে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। পরিবারে অন্য কোনো পুরুষ না থাকায় ইচ্ছা- অনিচ্ছায় ছামাদ মিয়াকে সংসারের দায়-দায়িত্ব বহন করতে হয়। বিশেষ করে হাট-বাজার কেনা-বেঁচা, জমি জমার দেখাশোনা, ফসলের খোঁজ খবর সব তাকেই রাখতে হয়। ভালোই চলে ছামাদ মিয়ার সংসার। ছামাদ এখন খুব সকালেই ঘুম থেকে উঠে। নিয়মিত ফসলের ক্ষেতে যায়। প্রায়শ সকালের নাস্তা মাঠে বসে খায়। হাটের দিন সময় মত হাটে যায়। কোনো সওদা কিনতে ভোলে না। কালী ঠাকুর যেমন চারুর জন্য গজা, বারো ভাজা কিনতে ভুলতেন না, ছামাদও ভোলে না। কালী ঠাকুরের মৃত্যুর দেড়-দুই বছর পর এলাকায় কলেরার পুসকার (মহামারী) দেখা দেয়! মানুষ ভয়ে আতঙ্কে ধর্মের দিকে ঝুকে পড়ে। সবাই ধর্ম পালনে ব্যস্ত হয়ে যায়। এ সময় ছামাদ মিয়াও নামাজ পড়তে শুরু করে। মাতা রুকীনি দেবী কলেরার ছোবল হতে রেহাই না পেয়ে মৃত্যু মুখে পতিত হয়। কিছুদিন পর কলেরা চলে গেলেও কলেরার ভয় মানুষের ভিতর হতে যায় না। পিতা-মাতা ভাই- বোন আপন আত্মীয় স্বজনহীন চারুবালা একেবারে একা! পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ছামাদ মিয়া তার ঘর হতে এসে উত্তর পোতায় বাস্তু ঘরের এক পাশে রাত্রি যাপন করে। অন্য পাশে থাকে চারুবালা। চারুর ভিতরের ব্যথার ক্ষত জমতে জমতে কঠিন হয়ে যায়। কোনো দুঃখ, ব্যথা, জ্বালা- যন্ত্রণা, হাসি, কান্না তার মনে রেখাপাত করে না। যদিও ছামাদ মিয়া চেষ্টার ত্রুটি করে না তাকে স্বাভাবিক রাখতে। সে চেষ্টা করে তার কোনো প্রকার অসুবিধা যেনো না হয়।
ছামাদ মিয়া এখন নিয়মিত নামাজ কালাম পড়েন। কখনও কখনও মসজিদে গিয়েও নামাজ আদায় করেন। এসব দেখে এক শ্রেণির গোড়া মুসলমানরা ছামাদ মিয়ার পিছু লাগে।
মুসলমানের ছেলে বিধর্মী হিন্দু বাড়িতে থাকে খায়! হিন্দু যুবতির সাথে একই বাড়িতে এক সাথে এক সংসারে থাকে। এমন লোকের পিছনে বা এক সাথে মসজিদে নামাজ পড়া যায় না! তাকে মসজিদে আসতে দিলে আমাদের পবিত্র মসজিদ অপবিত্র হবে।
তারা শুধু ছামাদ মিয়াকে মসজিদে নামাজ পড়া বন্ধ করেই থেমে থাকেনি। তার সাথে স্থানীয় সব মুসলমানদের সমস্ত প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করে। একেবারে তাকে একঘরে সমাজচ্যুত করে। ছামাদ মিয়ার সাথে কোনো মুসলমান কথা বলতে পারে না। এখানেই শেষ নয়। প্রতিবেশি হিন্দু মোড়লদেরও কান ভারি করেছে তারা। একদিন কালীতলার মন্ডপ প্রাঙ্গণে এলাকার হিন্দু সমাজকে ডাকা হয়। সভাস্থলে আলোচনায় আসে গোপালপুর গ্রামের স্বর্গীয় কালী ঠাকুরের অসূচি কন্যা। যার কিনা বিয়ের রাতেই স্বামী হারিয়ে যায়। এমন কুলটার বাড়িতে একজন মুসলমান যুবকের থাকা খাওয়া...! কচ
রাম রাম এ অন্যায় ভগবানও সইবেন না! আমরা যদি এর প্রতিকার না করি তবে আমরা সবাই দেব-দেবীর রোসানলে পতিত হবো। সব শেষে সমাজপতিরা সিদ্ধান্ত নেন,
Page No 3
আজ হতে কালী ঠাকুরের কন্যা চারুবালাকে হিন্দু সমাজচ্যুত করা হলো। এই অঞ্চলের কোনো হিন্দু নারী-পুরুষ তার সাথে কোনো প্রকার আলাপচারিতা, যোগাযোগ করতে পারবে না। মন্দির মন্ডপে দেবতার পদসেবা তার জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। এমন কি সে মৃত্যুবরণ করলে তার দেহ শ্বশ্মানের চিতায় দাহ করা যাবে না! কারণ সে জঘন্য পাপী!
তাকে সহযোগীতা করে তার পাপের ভাগিদার আমরা হতে পারবো না। ছামাদ মিয়া-চারু বালা দু'জনেই উপায়হীন। কি করবে কোথায় যাবে? ভেবে কুল-কিনারা না পেয়ে এক গভীর রাতে ঘরের অপর কক্ষ হতে চারুবালা একটু জোরেই বলে,
ঘুমাইছেন না কি..?
উত্তরে ছামাদ মিয়া বলেন,
ঘুম কি আর আসে? ঘুমের রাজ্য এখন অন্ধ বোবা কালা গোড়া ধর্মীয় সমাজ পতিদের দখলে! আমার চোখে আসার সুযোগ নেই। তুমি কেনো জেগে আছো?
চারুবালা উত্তরে বলে,
আপনার কারণে, আপনার ভাবনায়। আমি অপয়া, অসূচি, অশুভ, কুলটা মেয়ে মানুষ! আমার জন্যে এই অপমান অপদস্ততা কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে কেন পড়ে আছেন? আগামী কাল সকালেই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন!
ছামাদ মিয়া কোনো কথা না বলে চুপ করে থাকে। আবারও চারুবালা বলে, চুপ কেনো? আমার কথা বুঝতে পারেননি?
ছামাদ এবার সব জড়তা ভেঙ্গে মনের ভিতর লুকানো অনেক দিনের অব্যক্ত কথাগুলি গড় গড় করে বলতে থাকে,
আমি চলে গেলেই তুমি কি খুশি হও? তা না হয় হলে। কিন্তু আমি তোমাকে কার কাছে কী ভাবে রেখে যাবো? আর আমার যদি এখান হতে যেতেই হয় তবে তোমাকে নিয়েই যাবো।
হঠাৎ এই কথা শুনে চারুবালার কঠিন হৃদয় হতে লুকানো উষ্ণতায় শীতল বরফ একটু একটু করে গলতে থাকে। চারুবালা ভাবনায় উদাস হয়ে কল্পলোকে বিচরণ করতে থাকে। রাতের প্রস্থানে সকালের আগমন ঘটে। নিয়মতান্ত্রিক ভাবে চারুবালা ঘুম হতে উঠে রান্না খাওয়া শেষ করে। ছামাদ মিয়াকে ডেকে উঠানের পঞ্চমুখি জবা আর তুলসি গাছের পাশে মাদুর পেতে বসে। ইতিমধ্যে চারুর হৃদয়ের বরফ গলা পানি অনেক দূর গড়িয়ে গেছে।
বহুদিন পর জলে ভাসা শেওলা চারুর একটা ভাসা দন্ডের আলো চোখে পড়ে। নতুন আশার বাসা বাঁধার স্বপ্নে সে বিভোর! ফাগুনি বসন্তের দখিনা সমিরণ যেনো সমস্ত শরীর মনকে দোলা দিয়ে যাচ্ছে। কথোপকথনের মধ্যে উভয়ে আবেগি মনের সব আকুতি মিনতি একেবারে মেলে ধরে। খোলা- মেলা আলোচনা না হলেও একে যে অপরের পরিপূরক উভয়ে বুঝতে পারে। আল্লাহ, হরি সৃষ্টিকর্তা রক্ষাকর্তা তিনি সবার সব কিছুর উর্ধ্বে। তিনি কোনো ব্যক্তি বা সমাজের নয়।
তারা সিদ্ধান্ত নেন ছামাদ মিয়া এখন থেকে বাড়িতেই নামাজ আদায় করবেন। এবং চারুবালা বাড়িতেই ঠাকুর স্থাপন করে তার পূজা অর্চনা করবেন। একে অপরকে তার ধর্মপালনে সহযোগিতা করবে। এই সিদ্ধান্তে রান্না ঘরের একপাশে ভিন্ন কক্ষ তৈরি করে ছামাদ মিয়া চারুবালার পূজার সুব্যবস্থা করে দেন। নিজে শয়ন কক্ষের একপাশে একটা জলচৌকির ব্যবস্থা করে নামাজ আদায় করতে থাকেন।
সময় গড়ায়। দিন, মাস, বছর। বদলে যায় প্রকৃতি, সমাজ। একই সাথে অব্যক্ত ভালোবাসা ভালোলাগা যৌবন জোয়ারের নদীতেও ভাটার টান আসে। কেউ কাউকে স্পষ্ট করে কিছুই বলে না। শীতকালে ছামাদ মিয়ার ফজরের নামাজের অজুর পানি চারুবালা গরম করে দেন। এবং জায়নামাজসহ ছামাদের সব কাপড়চোপর তিনিই পরিষ্কার করে দেন। চারুর পূজা-পার্বনেও যখন যা কিছুর প্রয়োজন হয় ছামাদ মিয়া যথাসময়ে তা ব্যবস্থা করেন। দূর্গা পূজার সময় চারুর জন্য শাড়ি কিনতে ছামাদ মিয়া কখনও ভুল করে না। আবার ঈদ আসলে চারুবালা ছামাদ মিয়াকে নতুন লুঙ্গী, পাঞ্জাবী কেনার জন্য খুব তাগিদ দেন। ছামাদ মিয়া লুঙ্গী পাঞ্জাবীর সাথে চারুর জন্য শাড়ি ব্লাউজ স্যান্ডেল কিনেন। প্রয়োজনে ছামাদ মিয়ার কক্ষে চারুবালা প্রবেশ করতেন কিন্তু চারুবালার কক্ষে ছামাদ মিয়া কখনও প্রবেশ করেনি। মানুষের ভালোলাগা ভালোবাসা প্রেম ব্যক্তি বিশেষ কেমন কত প্রকার হতে পারে তার রহস্য বোঝা খুবই দুঃসাধ্য। দীর্ঘ ত্রিশ বছর একই সংসারে একান্নে থেকে যৌবনের উন্মাদনা! বার্ধ্যকের সহচার্য্য সংবরণ, নিজেকে লুকিয়ে স্বাভাবিক ভাবে জীবন যাপন, স্বর্গীয় দেবতাদের পক্ষেও অসম্ভব। কিন্তু মর্তের পৃথক ধর্ম সমাজ সংস্কৃতি নারী পুরুষ জীবন কাল অতিবাহিত হয়; যা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। তাদের উপর সমাজচ্যুত সহ বিভিন্ন ধরনের অন্যায় অত্যাচার করার পরও তাদের পৃথক করা সম্ভব হয়নি। সময়ের বিবর্তনে হিন্দু-মুসলনমান সকলেই তাদের সাথে মেলামেশা ও সামাজিকতা শুরু করে। ছামাদ মিয়া ইসলাম ধর্মীয় বিদ্যায় বেশ জানা শুনা। এখন মসজিদে এসে তিনি নামাজ কালাম পড়েন। মসজিদে ইমামতিও করেন। এবং পুরাতন জরাজীর্ণ মসজিদকে সংস্কার করে সুন্দর রূপে গড়ে তোলেন। পাড়ার লোকজন তাঁকে মুন্সী বলে ডাকতে শুরু করে। এক পর্যায়ে স্থানীয় মুসলমান-হিন্দু সবাই ছামাদ মিয়া নামের পরিবর্তে তাঁকে মুন্সী বলে ডাকে। চারুবালাও তাকে মুন্সী বলেই ডাকে।
জীবন স্রোতের গতিধারায় হঠাৎ এক রাতে চারুবালার অজান্তেই চারুকে ফাঁকি দিয়ে মুন্সীর প্রাণ পাখি চলে যায়, না ফেরার দেশে! রাত শেষ প্রভাতের আগমনী বার্তায় বুনো পাখিরা কিচির মিচির রবে ডেকে নিত্যদিনের মত বাসা ছেড়ে বাহির হয় খাবারের অন্বেষণে। তেমনি চারুবালারও ঘুম ভেঙ্গে যায়। ব্যস্ত ভরে বিছানা হতে উঠে প্রতিদিনকার ধর্মীয় আহ্নিক পালন করে। ছামাদ মিয়ার শয়ন কক্ষের সামনে গিয়ে দেখে মুন্সী উঠেনি। তাই শুধু ঘরের সামনের বারান্দাটা আওলা মাটির প্রলেপ দিয়ে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পূর্ব আকাশে লাল সূর্য ডগ ডগ করে গাছের উপরে উঠে। কিন্তু মুন্সীর ঘুম ভাঙ্গে না। বাহির হতে ডাকা ডাকি করেও কোনো সাড়া মিলে না। এমন সময় ঘরের চালের উপর একটা দাঁড় কাক কা কা শব্দে ডাকতে থাকে। এই দেখে চারুবালা হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে। ছুটে আসে প্রতিবেশিরা। চৌকাঠ ভেঙ্গে ঘর হতে বের করা হয় মুন্সীর লাশ! হতবাক চারু! নির্বাক হয়ে দেখে, দীর্ঘ দিনের একমাত্র জীবন সাথীর শেষ গোসল কাফন দাফন!
ঘটনার অনেক বছর পর, এক বিকালে আমি কর্মস্থল হতে বাড়ি ফিরছি। পথে নড়াইল সদর উপজেলার গোপালপুর গ্রামের একটা মসজিদে আছরের নামাজ আদায় করি। মসজিদ হতে বের হওয়ার সময় চোখ পড়ে মসজিদের পার্শে একটা কবরকে সামনে রেখে এক হিন্দু বৃদ্ধা কান্নাকাটি করছেন। কান্নার ব্যাকুলতার সাথে সাথে বলতেছেন,
মুন্সী না কয়ে চলে গ্যালে ক্যানরে মুন্সী, না কয়ে চলে গ্যালে ক্যান! তুমি কোনো দিনও দ্যাখলে না আমি রান্না ঘরে সারা জীবন কার পূজা করি? খালি সারাজীবন নৈবেদ্য জোগাড় করে গেলে, অর্থ নিবেদনের সুযোগটা দিলে না? কিছুই তো বলে গেলে না!
এই সেই চারুবালা, যার জীবন কাহিনী অবলম্বনে গল্প “চারুর পূজা।"
Page No 4