মেঘলা আকাশের নিচে রিস্তা দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে ঝড়ের পূর্বাভাস। বাতাসে অদ্ভুত একটা অস্থিরতা। আজ সাত বছর পর এই শহরে ফিরে এসেছে সে। যে শহর তাকে শুধুই কষ্ট দিয়েছে, আবার জীবনের অনেক কিছু শিখিয়েছেও।
স্মৃতিগুলো মেঘের মতো ভিড় জমিয়েছে মনে। শুভর সঙ্গে প্রথম দেখা, প্রথম প্রেম, আর শেষ বিচ্ছেদ। শুভর হাসিটা যেন এখনো চোখে ভাসে। সেই দিনটা স্পষ্ট মনে পড়ে, যেদিন শুভ তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। কোনো কারণ না জানিয়ে। কোনো কথা না বলে। শুধু একটা চিঠি রেখে গিয়েছিল, যেখানে লেখা ছিল, “আমাকে খুঁজে বোলো না। ভালো থেকো, রিস্তা।”
রিস্তা ভেবেছিল সব শেষ। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। সে নিজেকে বদলে নিয়েছিল। নিজের স্বপ্নগুলোকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে গিয়েছিল। কর্পোরেট দুনিয়ায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। কিন্তু সেই শূন্যতা? সেটা কি কখনো পূরণ হয়?
আজ এত বছর পর একটা ইমেল পেয়ে সবকিছু বদলে গেল। ইমেলে শুভ লিখেছে, “তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই। একবার। নদীর পাড়ে, যেখানে আমরা শেষবার দেখা করেছিলাম। আসবে?”
রিস্তা দ্বিধায় পড়েছিল। কিন্তু শেষমেশ এসেই পড়েছে। মন বলছে উত্তর খুঁজতে গেলে এই সুযোগটাই হয়তো শেষ।
নদীর পাড়ে পৌঁছে দেখে শুভ আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছে। চেহারায় পরিণতির ছাপ, কিন্তু চোখের গভীরতা একই। শুভ এগিয়ে এলো।
“কেমন আছো, রিস্তা?”
“ভালো। তুমি?”
“জীবন চলছে। কিন্তু একটা কথা বলা বাকি ছিল, তাই ডেকেছি।”
“সাত বছর পর?” রিস্তার কণ্ঠে তিক্ততা। “এত দেরি হয়ে গেল?”
শুভ একটু থেমে বলল, “তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার দিনটায় আমি ভেবেছিলাম তোমার জন্য সেটাই ভালো হবে। কিন্তু ভুল করেছিলাম। আমি... আমি ক্যানসারের রোগী ছিলাম, রিস্তা। ডাক্তারেরা তখন বলেছিল মাত্র কয়েক মাস বাঁচব। আমি তোমার জীবনে বোঝা হতে চাইনি।”
রিস্তার বুক ধক করে উঠল। “তাহলে ফিরে এলে কেন?”
“ডাক্তারদের ভুল প্রমাণ করে বেঁচে আছি। কিন্তু সেই সময়ে তোমার থেকে পালিয়ে গিয়ে যে ভুল করেছি, তার ক্ষমা চাইতে এসেছি।” শুভর চোখে জল চিকচিক করছিল।
রিস্তা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “তুমি ভাবলে তুমি চলে গেলে আমি ভালো থাকব? তুমি জানো না, তোমার অনুপস্থিতি আমাকে কতটা ভেঙে দিয়েছিল। কিন্তু এখন এতদিন পর এই গল্প শোনার প্রয়োজন নেই, শুভ।”
“তাহলে?” শুভ অসহায় কণ্ঠে বলল।
“তোমার এই ফিরে আসা আমার জন্য একটা বন্ধ দরজা খুলে দিল। প্রাক্তনের জায়গা কখনো ফাঁকা থাকে না, শুভ। তুমি ছিলে, থাকবেও, কিন্তু আমার জীবনে এখন অন্য গল্প চলছে।”
শুভ বোঝার চেষ্টা করল। “তুমি কি কাউকে পেয়েছ?”
রিস্তা মৃদু হাসল। “হ্যাঁ। নিজের ভালো থাকা খুঁজে পেয়েছি। আর সেটাই আমার সবচেয়ে বড় জয়।”
শুভ চুপ করে গেল। নদীর বাতাস বয়ে যাচ্ছিল।
“তোমার জন্য শুভকামনা রইল,” রিস্তা বলল। “তুমি সাহস নিয়ে বেঁচে আছ, সেটাই যথেষ্ট।”
শুভ তাকিয়ে রইল রিস্তাকে দেখে। তার চোখে কৃতজ্ঞতা আর বিদায়ের ছাপ। রিস্তা ফিরে চলল নতুন জীবনের পথে। প্রাক্তনের উপস্থিতি স্মৃতি হয়ে গেল, কিন্তু সেই স্মৃতির ভার আজ আর ছিল না।
Page No 1