বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন। ক্যাম্পাসের বিশাল চত্বরে তৌফিক অস্থির হয়ে ঘুরছিল। নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ—সবকিছুই তার কাছে অচেনা। এমন সময় একটা নরম কণ্ঠ শোনা গেল, "আপনি কি ১০১ নম্বর কক্ষে যাচ্ছেন?" পেছন ফিরে তৌফিক দেখল, একটা শান্ত মুখ। মেয়েটার চোখে কেমন যেন একধরনের অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল। সে হ্যাঁ বলল। মেয়েটি পরিচিত হল, নাম অরুণা। সেদিন তাদের বন্ধুত্বের শুরু।
তৌফিক ও অরুণা ধীরে ধীরে একে অপরের ভালো বন্ধু হয়ে ওঠে। ক্লাসের বাইরে বই পড়া, আড্ডা দেওয়া, প্রজেক্টে একসাথে কাজ করা—এইসব ছোটখাটো মুহূর্তে তাদের বন্ধুত্ব গভীর হয়। অরুণার সরল হাসি আর তৌফিকের উদাসীন কথোপকথনে তারা যেন একে অপরের জীবনের পরিপূরক হয়ে ওঠে।
একদিন বর্ষার সন্ধ্যায়, বৃষ্টিতে ভেজা এক মুহূর্তে, তৌফিক অরুণাকে বলে ফেলে, "তুমি কি জানো, তোমাকে ছাড়া আমার জীবনটা কেমন যেন শূন্য মনে হয়?" অরুণা চুপ করে থাকে, কিন্তু তার চোখ বলে দেয়—সে তৌফিককে ঠিক একইভাবে ভালোবাসে। সেদিন থেকে তাদের বন্ধুত্বের নাম হয় ভালোবাসা।
তাদের ভালোবাসা চলতে থাকে, কিন্তু বাস্তবতা তাদের পিছু ছাড়ে না। তৌফিক উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। অন্যদিকে অরুণার পরিবার তাকে দ্রুত বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে। তৌফিক ভাবে, সে ফিরে এসে সব ঠিক করে নেবে। কিন্তু অরুণার পরিবার এতদিন অপেক্ষা করবে না। তাদের মধ্যে অদ্ভুত এক অস্থিরতা জন্ম নেয়।
একদিন অরুণা তৌফিককে বলে, "তুমি যদি ফিরে না আসো, আমি কী করব? আমার পরিবার আমাকে অন্য কারও সাথে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে।" তৌফিক তখনো নিজের স্বপ্নে বিভোর। সে প্রতিশ্রুতি দেয়, "আমি ফিরে এসে তোমাকে আমার করে নেব।"
তৌফিক বিদেশে চলে যায়। প্রথম কয়েক বছর তাদের সম্পর্ক দূরত্বেও অটুট থাকে। ফোনে কথা বলা, ভিডিও কল, ইমেইল—সবই চলতে থাকে। কিন্তু ধীরে ধীরে তৌফিক ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তার ক্যারিয়ারের চাপ, নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ—এইসবের মাঝে অরুণার জায়গা যেন ছোট হয়ে আসে।
অন্যদিকে অরুণা তার পরিবারের চাপ আর নিজের একাকীত্ব নিয়ে সংগ্রাম করতে থাকে। সে বুঝতে পারে, তৌফিকের ভালোবাসা এখনো গভীর, কিন্তু তাদের মধ্যে সময় আর দূরত্ব এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করেছে।
অরুণার বিয়ে ঠিক হয়। সে একদিন তৌফিককে ফোন করে জানায়, "আমার আর সময় নেই। তুমি কি আসবে?" তৌফিক কোনো উত্তর দিতে পারে না। সে কাঁদতে কাঁদতে বলে, "আমি খুব দুঃখিত, অরুণা। আমি সময়মতো ফিরতে পারলাম না।"
অরুণার বিয়ে হয়ে যায়। তৌফিক ভেঙে পড়ে। সে নিজেকে দোষী মনে করতে থাকে। তার মনে হয়, সে শুধু নিজের স্বপ্নের পেছনে ছুটে অরুণাকে হারিয়েছে।
বছরখানেক পর এক শীতের সকালে, তৌফিকের জীবনে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। সে একটি কফি শপে ঢোকে এবং সেখানে অরুণাকে দেখে। অরুণা এখন বিবাহিত। তার চোখে বিষাদের ছায়া। তৌফিক তাদের পুরনো স্মৃতির কথা বলে। অরুণা হেসে বলে, "সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না, তৌফিক। আমাদের গল্পটাই হয়তো এমনই হওয়ার ছিল।"
তৌফিক তার মনের সমস্ত ভার নিয়ে বিদায় জানায়। কফি শপ থেকে বেরিয়ে সে আকাশের দিকে তাকায়। তার মনে হয়, এই অপূর্ণতাই হয়তো তার জীবনের সত্য।
গল্পটি শেষ হয় তৌফিকের একটি প্রশ্নের মাধ্যমে: "অরুণা, তুমি কি জানো, আমরা যদি আরেকটা জীবন পেতাম, তাহলে কি আমাদের গল্পটা ভিন্ন হতো?"
Page No 1