এক সন্ধ্যার কথা, শীতল হাওয়ার স্রোতে গা ছমছম করছে। গ্রামটির নাম ছিলো শান্তিপুর। চারপাশে সবুজ ফসলের মাঠ, নির্জনতার মধ্যে যেন প্রকৃতির নিজস্ব এক সংগীত বাজছে। কিন্তু সেদিন সেই সুরে কিছু যেন মিলল না—কিছু অস্বাভাবিক।
গ্রামের কেন্দ্রস্থলে এক পুরোনো বটগাছ। কথিত আছে, এই গাছটি শতাব্দী প্রাচীন এবং এটি অভিশপ্ত। সন্ধ্যার পর কেউ এর কাছাকাছি যায় না। কিন্তু সেদিন গাছটির নিচে এক বৃদ্ধ এসে হাজির হয়। কেউ তাকে আগে কখনো দেখেনি। পরনে ছিলো ধূসর ধুতি, পিঠে ফাটা কাঁধব্যাগ, আর মুখে অদ্ভুত এক রহস্যময় হাসি।
বৃদ্ধটি ধীর পায়ে গাছটির নিচে বসে পড়ল। তার হাতে ছিলো এক পুরোনো মাটির প্রদীপ। সেটা জ্বালিয়ে সে ফিসফিস করে কিছু বলতে শুরু করল। যারা দূর থেকে দেখছিলো, তারা ভয়ে কাঁপতে শুরু করল।
হঠাৎ, আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল। বিদ্যুৎ চমকানোর সাথে সাথে বটগাছের ডালপালা নড়তে শুরু করল। একটা অস্বাভাবিক আওয়াজ শোনা গেল—কান্না, চিৎকার, আর হাসি একসাথে মিশে যেন বাতাসকে ভারী করে তুলল। গ্রামের মানুষজন একে একে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তারা দেখল, বৃদ্ধটি প্রদীপটি উঁচু করে ধরে একমনে মন্ত্র পড়ছে।
“কে তুমি?” সাহস করে জিজ্ঞাসা করল গ্রামের মোড়ল।
বৃদ্ধটি ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, “আমি সময়ের দূত। কিন্তু সময়ের ভুলে এখানে চলে এসেছি। তোমাদের এই গ্রামে আজ অসময়ের আবির্ভাব হবে। প্রস্তুত হও।”
গ্রামের সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। তারা জানত না কী হতে চলেছে। বৃদ্ধটি তার কথা শেষ করেই অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু বটগাছটি যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। তার শিকড় মাটি থেকে উঠে এসে পুরো গ্রামটিকে গ্রাস করতে শুরু করল।
মানুষ ছুটতে শুরু করল, কিন্তু কেউ পালাতে পারল না। সময় যেন থমকে গেল।
গ্রামের মানুষজন একে একে দিশেহারা হয়ে পড়ল। বটগাছটির শিকড় যেন তাদের পায়ের নিচের মাটিকেও গ্রাস করে নিচ্ছিল। বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে, আর সময় যেন থেমে গেছে। হঠাৎ, বটগাছের মধ্য থেকে এক গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এল, “তোমাদের সময় শেষ। অসময়ের ফসল তুলতে এসেছি আমি। তোমরা যা ভুল করেছ, তার মাশুল দিতে হবে।”
মোড়ল সাহস করে সামনে এগিয়ে গেল। “কী ভুল? আমরা তো কিছুই জানি না!”
গাছের কণ্ঠস্বর বলল, “ভুল ছিলো তোমাদের লোভ। এই মাটি, এই প্রকৃতি, এই সময়—সবকিছুর সঙ্গে তোমরা অন্যায় করেছ। এতদিন ধরে জমি, গাছপালা, প্রাণীকুলের ওপর তোমাদের অত্যাচার জমা হচ্ছিল। আমি অসময়। যখন নিয়ম ভাঙে, তখনই আমার আবির্ভাব ঘটে।”
গ্রামের মানুষ স্তব্ধ হয়ে গেল। তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠল তাদের লোভের কীর্তি—বনের গাছ কেটে ফেলা, নদীর জল দুষণ করা, এবং প্রাণীদের আবাস নষ্ট করা। কেউ কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেল না।
হঠাৎ, এক শিশু কাঁপতে কাঁপতে সামনে এগিয়ে এল। তার ছোট্ট হাতে ছিলো একটি ফুলের ডালি। সে বটগাছের সামনে নত মস্তকে ডালিটি রেখে বলল, “আমরা যদি আমাদের ভুল স্বীকার করি, তাহলে কি ক্ষমা পাবো?”
গাছটি মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। চারপাশে নীরবতা নেমে এল। তারপর গাছের কণ্ঠ বলল, “ক্ষমা চাইতে জানলে তবেই ক্ষমা পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করো। এই শিশুটি যা করেছে, তা তোমাদের জন্য শিক্ষা। যদি তোমরা প্রকৃতির প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হও, তাহলে অসময় তোমাদের ছেড়ে যাবে।”
মোড়ল এবং গ্রামের লোকেরা একসঙ্গে প্রতিজ্ঞা করল, “আমরা প্রকৃতিকে রক্ষা করব। আমরা সময়ের প্রতি সম্মান দেখাব।”
তারপর, ধীরে ধীরে বটগাছটি স্থির হয়ে গেল। কালো মেঘ কেটে গিয়ে আবার নীল আকাশ দেখা গেল। শিশুটি মাটির প্রদীপটি হাতে তুলে নিল এবং মৃদু আলো জ্বলতে লাগল।
বৃদ্ধটি আর দেখা গেল না। তবে তার কথাগুলো মানুষের মনে রয়ে গেল।
গ্রামের মানুষ প্রকৃতির প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করল। তারা গাছ লাগানো শুরু করল, নদী পরিষ্কার রাখল, আর কোনো প্রাণীর ক্ষতি করল না। বটগাছটি শান্তিপূর্ণভাবে গ্রামে রইল, যেন প্রহরীর মতো।
Page No 1