writerfair

মনোরমা

Manorama

Wahid Zaman

প্রথম অংশ

আজ মনোরমার কথা খুব মনে পড়ছে। ও ছিল আমার ছোটবেলার খেলার সাথী, পড়ার সাথী। একত্রে স্কুলে যেতাম। দুজনে বৃষ্টিতে কত ভিজেছি। চাঁদনিরাতে খোলা আকাশের নিচে এমনি কী যেন এক গল্প করে রাত পার করেছি।

বয়সে মনোরমা আমার চার-পাঁচ বছরের ছোট হবে। তবুও দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্কের কোন কমতি ছিলো না।

মনোরমার মা ছিল না। জন্মের কয়েক বছর পরে মারা যায়। বাবার কাছে মানুষ। এজন্য কোমল স্নেহ পরশ ব্যবহার তার কাছে আশা করা দূরহ ছিলো। তবে একটা বিষয় পরিস্কার ছিল- সকলের সাথে যেমন ব্যবহার করত, আমার সাথে তেমন হত না। সে আমার কোন এক শুভ লগ্নে মনের মানুষ হয়ে জন্মেছিল। এ এক বিশেষ সুবিধা ছিল আমার। কারণে-অকারণে আমি তাকে অপমান করতাম কিন্তু সে কোন অনুযোগ বা প্রতিবাদ করত না।

মা ছিল না বলে মনোরমা আমার মাকে মা বলে ডাকত। আমার মা তাকে নিজের মেয়ের মত স্নেহ করতেন। আদর করে মা তাকে সম্পূর্ণ নামে না ডেকে 'মনো' বলে ডাকতেন। মা মনোরমাকে বিশেষ আদর করতেন বলে সময়ে সময়ে আমার খুব হিংসে হত।
 

Page No 1


দ্বিতীয় অংশ

মা মনোরমাকে দুটি কারণে বেশি ভালোবাসতেন। এক, তার মা ছিল না। দুই, পুত্রবধূ করবার শখ ছিল। বাবা-মা মনোরমার সাথে আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য যুক্তি করতেন। এটা বোধহয় মনোরমা বুঝতো। এজন্য সর্বসাধারনের চেয়ে তার প্রতি আমার যে একটা বিশেষ অধিকার ছিল তা সে মানত। নচেৎ কারণে-অকারণে আমার লাঞ্চনা সইবার আরতো কোন কারণ দেখি না।

একবার কীএক কারণে আমি মনোরমাকে চড় দিয়েছিলাম।। ভেবেছিলাম কেউ দেখেনি। মা দূর থেকে দেখেছিলেন। তিনি তো রেগে অস্থির হয়ে আমাকে বকা দিয়েছিলেন। আমি একটু কষ্ট পেয়েছিলাম। কারণ, মা কখনো আমাকে বকুনি দেননি। এই প্রথম

ঐ দিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মা আমার রুমে এসে অনেক আদর করেছিলেন। আর এও বললেন, 'খোকা তোর জন্য' আমি মনোকে সাব্যেস্ত করেছি। তুই ওকে আর কখনও কিছু বলবি না। এটা আমার আদেশ।'

আমি তো হতবাক। আমাকে বিব্রতকর অবস্থায় দেখে তিনি বললেন, 'এখনি নয়, সবকিছু তোর পড়ালেখা শেষে হবে। একথা বলে তিনি চলে গেলেন।

এই ঘটনার পর হতে আমি মনোরমার কাছ থেকে দূরে থাকতাম। ওকে, যে আমার ভালো লাগতো না, তা নয়। কী এক বিশেষ কারণে আমি ওর ধারে-কাছে আর তেমন ভিড়তাম না। এটা মনোরমা বুঝতো কিন্তু কিছু বলত না। এভাবে বেশ অনেক দিন অতিক্রান্ত হল। মনোরমা নানা অজুহাতে আমার কাছে আসত আমাকে বিশেষ সমাদর করার চেষ্টা করত। আমি সুকৌশলে এড়িয়ে যেতাম। আসলে ঐ মুহূর্তে কী করা দরকার তা বুঝে উঠতে পারতাম না ।
 

Page No 2


তৃতীয় অংশ

একদিন আমি পুকুরধারে পড়ন্ত বিকেলে বসে আছি। চারিদিকে নীরবতা। হঠাৎ পিছনে কারোর উপস্থিতি টের পেলাম। ফিরে দেখি মনোরমা। কিন্তু এ এক অন্যরকম মনোরমা। কেমন যেন বিভৎসতা তার সারা মুখ জুড়ে। আমি কিছু বলার আগে ও বলল, আমি আপনার কী ক্ষতি করেছি?
আমি বললাম, কেন?
আপনি আমাকে এড়িয়ে চলেন কেন?
কই নাতো।
আমি সব বুঝি। এই বলে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল।
আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। আমি এটুকু বুঝেছিলাম মনোরমা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মনে মনে ফন্দি আঁটতে লাগলাম কী করে তার থেকে দূরে থাকা যায়।
আমি যে মনোরমাকে ভালোবাসতাম না তা কিন্তু নয়। আমি চেয়েছিলাম উচ্চশিক্ষা শেষ করে বড় কিছু হতে। তারপর এসব নিয়ে ভাবতে। কিন্তু মা এ ব্যাপারে অস্থির হয়ে উঠলেন। তিনি শুভ কাজে বিলম্ব করতে চাইলেন না। ক্রমশ বাড়ির পরিবেশ আমার প্রতিকূলে চলে গেল। আমার ঠিক কী করা দরকার আমি তা বুঝে উঠতে পারলাম না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, এখানে আর এক মূহূর্ত নয়। সময় বুঝে বাড়ি থেকে পালিয়ে এলাম।
 


ঢাকায় এক বন্ধুর কাছে উঠেছিলাম। বেশ কিছু দিন ছিলাম। এর মধ্যে একটা চাকরিও জুটল প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে। বন্ধুর বাসা নিরাপদ মনে হচ্ছিল না। কারণ আত্মীয়স্বজনেরা আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। ওখান থেকে চলে আসলাম।
আমার চাকরিটা ভালই চলছিল। কিন্তু ভাগ্য খারাপ হলে যা হয়। একদিন আমার প্রতিষ্ঠানে একটা বড় অর্থনৈতিক গোলযোগ ধরা পড়ে। আমি নিরপরাধ সত্বেও কয়েকজনের সঙ্গে ফেঁসে গেলাম।

আমার দশ বছর জেল হয়। তারপর বাড়ির সাথে আমার সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়।
জেল থেকে মুক্তির পর আর বাড়ি ফিরে যাইনি। ভাবলাম এ মুখ বাবা-মা'কে কীভাবে দেখাব। এভাবে আরও পাঁচ বছর পার হল। বাড়ির খোঁজ খবর রাখতাম না। ঢাকায় একটা ছোট কাজ করে চলতাম।
হঠাৎ একদিন আমাদের গ্রামের মধুদা'র সাথে মতিঝিল দেখা। সে এক অন্যরকম ভালোলাগা। প্রায় দেড় যুগ পরে কোন এক আপনজনের সাথে আমার প্রথম দেখা। দাদা আমাকে দেখে প্রথমে চিনতে পারেননি। আমি আগে চিনেছিলাম। তারপর নানা গল্প- ইতিহাস। অনেক দিন পরে আপনজনদের খোঁজ নিতে ভালোলাগার কথা। কিন্তু পোড়া কপালে কী ভালো কিছু আছে?
মধুদা এক এক করে সব বলতে লাগলেন। বাবা হঠাৎ এক রাতে মারা গিয়েছিলেন। মনেহয় স্ট্রোকে। তারপর আমার আর বাবার শোকে মা পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয়ে অবশেষে মারা যান।
মধুদা অনেক অনুরোধ করেছিলেন বাড়ি ফিরে যেতে। বলেছিলেন, তোমাদের অনেক জায়গা-সম্পত্তি, কে দেখবে এগুলো? সব বারো ভূতে লুটেপুটে খাচ্ছে!
আমি কোন উত্তর দেইনি। মনেরমার কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। ও এখন দুই সন্তানের জননী। স্বামীটা নাকি ভীষণ ডানপিটে এবং বদমেজাজী। ওকে অনেক কষ্ট দেয়।

আজ সত্যি জীবনের হিসাব মিলছে না। কেন যেন সব ধোঁয়াশা মনে হচ্ছে। কী এমন লাভ হলো মনোরমাকে ফাঁকি দিয়ে। জীবনযুদ্ধে তার মত আমিও তো একজন পরাজিত সৈনিক!
 

Page No 3