বাংলাদেশের এক অজ পাড়াগাঁ, নাম শিমুলিয়া। সেখানকার সরল জীবন, মাঠে-ঘাটে আর কাঁচা রাস্তার ধুলোমাখা পথঘেঁষে চলা মানুষের গল্প বলে। এই গ্রামে বড় হচ্ছে রিফাত। বয়স মাত্র বারো, তবে সে গাঁয়ের সবার চোখের মণি। রিফাতের জীবনটা ঠিক যেন শীতের সকালের কুয়াশার মতো—একটু রহস্যময়, একটু স্বপ্নমাখা।
রিফাত ক্লাস ৬-এ পড়ে। স্কুলটা তার বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে। প্রতিদিন সকালে উঠেই সে গামছা নিয়ে পুকুরঘাটে যায়। পুকুরের ঠাণ্ডা পানিতে স্নান সেরে স্কুলড্রেস পরে বেরিয়ে পড়ে। তার সঙ্গে থাকে বন্ধু রাশেদ আর লিপি। পথে ধানক্ষেতের মাটির গন্ধ, ঝিঁঝিঁ পোকাদের গান, আর মাঝে মাঝে কোনো চেনা-অচেনা পাখির ডাক তাদের যাত্রাকে করে আনন্দময়।
স্কুলের জীবনটা রিফাতের জন্য এক অন্য জগৎ। ক্লাসের ভেতর মাস্টারমশাইয়ের কঠিন অঙ্ক বা বাংলার কবিতার লাইন মুখস্থ করতে গিয়ে সে যতটা বিরক্ত হয়, টিফিনের সময় মাঠে ফুটবল খেলে ঠিক ততটাই মজা পায়। স্কুলে তার প্রিয় বিষয় হলো বিজ্ঞান। স্যার যখন মহাকাশ বা গ্রহ-তারকার গল্প বলেন, তখন রিফাত যেন সবকিছু ভুলে যায়। সে স্বপ্ন দেখে, একদিন সে বড় হয়ে বিজ্ঞানী হবে।
ক্লাস ৭-এ উঠতেই জীবনের গতি একটু বদলে যায়। মাঠে গরু চরানো আর বৈঠকখানায় বসে বড়দের গল্প শোনা কমে আসে। সন্ধ্যায় কুপি বাতির আলোতে পড়তে বসা তার জন্য এক রুটিন হয়ে দাঁড়ায়। একদিন গাঁয়ের মেলায় গিয়ে রিফাত একটা ছোট্ট টেলিস্কোপ দেখতে পায়। দাম শুনে মন খারাপ হলেও সে প্রতিজ্ঞা করে, একদিন নিজের টাকায় কিনবে। সেই রাতেই সে স্বপ্ন দেখে, সে এক অন্ধকার আকাশে তারার মাঝে ভেসে বেড়াচ্ছে।
ক্লাস ৮-এ এসে প্রথম প্রেমের অনুভূতিও টের পায় রিফাত। তার সহপাঠী লিপি একদিন তাকে একটা ছোট্ট ফুল দিয়ে বলে, "তোমার জন্য।" রিফাত কিছু বলতে পারে না, শুধু লজ্জা পেয়ে হেসে ফেলে। সে জানে না, এটা ভালো লাগা না অন্য কিছু। তবে তার মনে সেই মুহূর্তটা থেকে যায় চিরদিনের জন্য।
ক্লাস ৯ আর ১০-এর সময়টা ছিল জীবনের এক নতুন অধ্যায়। পড়াশোনার চাপ বেড়ে যায়। মাধ্যমিক পরীক্ষা সামনে, তাই স্যার-ম্যাডাম আর বাড়ির বড়রা সবাই তাকে পড়ার পেছনে লেগে থাকতে বলে। তবে তার মন কিন্তু বাইরের দুনিয়াতেই বেশি টানে। এক বিকেলে বন্ধু রাশেদের সঙ্গে নদীর ঘাটে বসে সে বলে, "আমাদের জীবনটা কত ছোট, তাই না? কিন্তু স্বপ্নগুলো কত বড়!"
একদিন মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট আসে। রিফাত গাঁয়ের প্রথম ছেলে, যে প্রথম বিভাগে পাশ করেছে। পুরো গ্রাম আনন্দে মেতে ওঠে। সবাই বলে, "এই ছেলেটা একদিন বড় কিছু করবে।"
রিফাতের সেই অজ পাড়াগাঁ থেকে শুরু হওয়া স্বপ্নের গল্প এখানেই শেষ নয়। এ গল্প আসলে শুরু, যেখানে সে শিমুলিয়ার মাটির গন্ধ নিয়ে এগিয়ে যায় নতুন দুনিয়ার পথে।
Page No 1