শহরের রাত
শহরের রাতের মতো কিছুই ছিল না, সব কিছু যেন স্থির, একধরনের অদ্ভুত নীরবতায় ডুবে ছিল। রাহুল জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল, হাতে এক কাপ কফি, আর চোখে এক গভীর ভাবনা। শহরের অসংখ্য আলো তার চোখে ঝলমল করছিল, কিন্তু তার মনে একটা অদ্ভুত খালি জায়গা ছিল। আজকের রাতটা অন্যরকম, খুবই অন্যরকম। মনে হচ্ছিল, কিছু একটা মিস হয়ে যাচ্ছে। কী তা, তা সে জানে না।
রাহুলের জীবনে অনেক কিছু ঘটেছিল। কত মানুষ এসেছে, কত মানুষ চলে গেছে। কিন্তু আজকের রাতটা যেন সমস্ত আগের রাতগুলোর থেকে আলাদা। কফির কাপে এক ফোঁটা জল পড়ল, তার দিকে তাকিয়ে ছিল রাহুল। জলটা চুপিসারে মিশে গেল কাপের ভেতর। তেমনই কিছু ঘটছিল তার জীবনে, সব কিছু ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছিল, যেন কিছু একটা শুরু হচ্ছে, আবার কিছু একটা শেষ হয়ে যাচ্ছে।
মনে পড়ল, আজই তো তার পুরনো বন্ধু আয়ান শহরে এসেছিল। কত দিন পর! শহরের ক্যাফে থেকে বেরিয়ে, তারা দুজনেই চলে এসেছিল রাহুলের কাছে। আয়ান যখন বলেছিল, "তুই কী জানিস, শহরের রাত কখনো অসমাপ্ত থাকে না, শুধু আমাদের চোখের সামনে সেগুলো অদৃশ্য হয়ে যায়," রাহুল তেমন কিছু উত্তর দেয়নি। কিন্তু এর পরের কয়েক ঘণ্টা, অদ্ভুত ভাবে, সেই কথাটা তার মনের মধ্যে খেলা করতে লাগল।
রাহুল ভাবছিল, কেন শহরের রাত কখনো অসমাপ্ত থাকে না? শহর তো শুয়ে পড়ে, সব কিছু থেমে যায়, তবে কীভাবে এ এমন অনুভূতি আসে যে, রাত কখনো শেষই হয় না?
হারানো সময়
অল্প সময়ের মধ্যেই রাহুল সেদিনের দিনটা মনে করতে লাগল। সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে সন্ধ্যা—সব কিছু যেন তার কাছে এক দীর্ঘ যাত্রার মতো ছিল। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, যেন এক দীর্ঘ সময় কাটানোর পর, রাতের আগমনে সব কিছু আবার এক নতুন মোড় নিচ্ছে।
অথচ, এই রাতে তার মধ্যে এক অদ্ভুত সুর ছিল। একটা ভাবনা, একটা চিন্তা ছিল যা তাকে পিছু নিয়ে চলছিল। রাহুল অনুভব করছিল, কিছু একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার সে ভুলে গিয়েছে। অনেক দিন পর মনে পড়ল, রাতের শহর যখন এত কিছু নিজের ভেতরে নিয়ে চলে যায়, তখন আমাদের কাছে কিছুই থাকে না। শুধু তীব্র অনুভূতিগুলি থাকে, যেগুলি প্রকাশ করতে পারি না।
কিন্তু রাতের মধ্যে এক অসমাপ্ততা থাকে। যেমন—শহর, মানুষ, সম্পর্ক—সব কিছু যেমন টেনে নিয়ে যায়, আবার ঠিক সেভাবেই ফেলে দিয়ে যায়। রাহুল জানত, তার জীবনে কিছু অসমাপ্ত অধ্যায় ছিল। কিছু সম্পর্ক, কিছু স্বপ্ন, কিছু স্মৃতি—যেগুলি একে একে শেষ হতে হতে, যেন কখনোই শেষ হয় না।
সন্ধ্যা এবং সন্ধ্যার পর
একদিন রাতে, রাহুল বেরিয়ে পড়েছিল। শহরের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, তার মনে হচ্ছিল যেন শহরের কোনো কোণে একটা গল্প অপেক্ষা করছে, একটি অসমাপ্ত গল্প। সে হাঁটছিল, আর মনে মনে ভাবছিল—এটা কি শুধু তার অনুভূতি, নাকি এটা শহরের রাতের গল্প, যা কখনো সম্পূর্ণ হয় না?
হঠাৎ, একদম সামনে থেকে তাকে ডাকল একটা পরিচিত কণ্ঠ। “রাহুল!” সেই কণ্ঠ তাকে চমকে দিল। সে বুঝতে পারল, সেই কণ্ঠটা ছিল শ্রেয়ার—তাদের সম্পর্ক, যেটি অনেক বছর আগে এক অসমাপ্ত পরিণতির দিকে চলে গিয়েছিল। শ্রেয়া, যা ছিল তার অতীতের একটা অজানা অধ্যায়। সেই সময়ের কথা মনে পড়তেই রাহুলের বুকটা ধক করে উঠল।
শ্রেয়া কাছে চলে আসল। তার মুখে অনেক কথা ছিল, কিন্তু কোনো কথা বেরোচ্ছিল না। রাহুল শুধু তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণের নীরবতার পর শ্রেয়া বলল, “তুমি কি কখনো ভাবো, কিছু সম্পর্ক কেন অসমাপ্ত থেকে যায়?”
রাহুল কিছু বলল না, কিন্তু মনে মনে সে বুঝতে পারছিল, তার জীবনেও একাধিক অসমাপ্ত সম্পর্ক ছিল, যেগুলি কোনওদিনই পূর্ণতা পায়নি। সম্পর্ক গুলি, যা সময়ের সাথে হারিয়ে গেছে, কিংবা কখনো শেষও হয়নি।
অসমাপ্ত রাত
রাত আরও গভীর হয়ে আসছিল। শহরের সাইরেন, গাড়ির আওয়াজ, দূরে কোথাও কোনো গান—সব কিছু যেন মিশে এক তীব্র অনুভূতিতে। রাহুল আর শ্রেয়া পাশাপাশি হাঁটছিল। অনেকটা সময় নীরবতা ছিল, তবে সেই নীরবতা যেন এক ধরনের ভাষা ছিল যা তাদের দুজনের হৃদয়ের গভীরে পৌঁছে যাচ্ছিল।
“আমরা কখনোই শেষ করতে পারিনি, রাহুল। জানো?” শ্রেয়া বলেছিল, তার কণ্ঠে কিছুটা বিষণ্ণতা ছিল।
রাহুল হাসল, “হয়তো, কিন্তু জীবন তো এমনই। কিছু কিছু রাত কখনোই শেষ হয় না। যেন তারা অসমাপ্ত থেকে যায়। হয়তো আমাদের সম্পর্কও তেমনি এক অসমাপ্ত রাত ছিল।”
এই কথাগুলোর মধ্যে একটা গভীরতা ছিল, যা রাহুল বুঝতে পারছিল, তবে তার কাছ থেকে কোনো উত্তর বের হচ্ছিল না। রাতের শহরের মধ্যেই, দুজনের মধ্যে একটা পুরনো সম্পর্ক যেন আবার জন্ম নিচ্ছিল। কিন্তু সেই সম্পর্ক শেষ হবে কি না, তা কেউ জানত না।
শহরের অসমাপ্ত রাতের মতো, তাদের গল্পও এক অসমাপ্ত অধ্যায় হয়ে রয়ে গেল, কখনোই পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাবে কি না, তা ছিল একটি রহস্য।
Page No 1