নভেম্বরের শেষশেষ, হালকা শীতের আমেজ চারদিকে, নিমগাছের পাতাগুলো ঝরে যাচ্ছে একেএকে। শিমুল, মান্দাল এরাও তাল মিলিয়েছে তার সাথে। মাঠেঘাটে ফুটছে ঘাস, ভাট,শ্বেতদ্রোন, রক্তকাঞ্চন, চেরী নানা রঙের ফুল।
বাগানে ফুটেছে গোলাপ, জবা গাঁদা, অবশ্য কিছু গাছের আবার কুঁড়ি ফুটবে ফুটবে ভাব, তারা যেনো নববধূর মতো লজ্জায় ঘোমটা মাথায় দিয়ে আছে।
জানালার ধারে লাগানো গাছগুলো কেমন জানি শীতের আগমনে ম্লান হয়ে আছে। ঘরের ভিতরেও তাপমাত্রা কমে আসছে, আলো-আঁধারির এক অজানা খেলা চলছে পালাক্রমে।
তারই মাঝে শেষ বিকেলে স্নিগ্ধা বসে আছে পুরাতন ডায়রিটা হাতে নিয়ে,পাতা উল্টাচ্ছে একের পর এক। ইদানিং প্রায়ই দুপুরে খাওয়ার পর গা এলিয়ে দেয় না আর বিছানায়, ছোট দিনে ঘুমাতে ইচ্ছে করে না তার, ঘুম থেকে উঠে কেমন অবসন্ন লাগে, মন খারাপ হয়ে যায়।
তাই এখন অবসর সময়ে ডায়রিটা পড়ে সে, আর অতিত স্মৃতিগুলো মনে করে আত্মসুখ খোঁজে।
ফাঁকা বাসায় বেশিরভাগ সময় একাই কাটাতে হয় তার। ছেলেটা বড়, পড়ালেখার জন্য সে ভারতের শিলং'য়ে থাকে, বছর পরে আসে, তবুও অল্প সময়ের জন্য।
ছোট মেয়ের বিয়ে হয়েছে বছর দুয়েক হলো, ঢাকাতেই থাকে। কিন্তু মেয়ে- জামাই দুজনেই চাকুরী করার জন্য এদিকে তেমন একটা আসতে পারে না, মাঝেমাঝে অবশ্য ফোনে কথা হয় ওদের সাথে, কিন্তু তাতে কি আর একাকীত্বতা ঘুঁচে!!
স্নিগ্ধার বর ব্যবসা করেন, তাই প্রতিদিন সকাল সকাল ব্যবসা সামলাতে, তাকে টঙ্গি থেকে মতিঝলে আসতে হয়।
স্নিগ্ধা অবশ্য পাশেই একটা কেজি স্কুলে চাকুরী করতো। ব্যস্ততার মাঝে সময়টা তার ভালোই কেটে যেতো। অল্পকিছু দিন হলো, বয়সের কারনে চাকুরীটা তাকে ছেড়ে দিতে হয়েছে।
এখন প্রচুর অবসর তার হাতে, তাই তো বিষন্নতা কাটাতে ডায়রিটা নিয়ে বসে সে। আজ পড়তে পড়তে তার এক জায়গায় এসে চোখ আটকে যায়, হারিয়ে যায় সে অতিতের মাঝে --------
অত্যন্ত বিমর্ষ আর করুন চাহনিতে শফিক তাকিয়ে থাকে স্নিগ্ধার দিকে, কেউ কোন কথা বলছে না, কথা বলার ভাষা যেনো হারিয়ে ফেলেছে দু'জনেই। পার্কের পাশ দিয়ে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে, লোকজনের কোলাহল আর কিছু সময় পরপর পাখির কুহুকুহু ডাক কানে আসছে।
--- তুমি ভেঙ্গে পড়ো না,,,, আমি কিছুদিনের মধ্যেই চলে আসবো তোমার কাছে, আমায় মাত্র একটি বছর সময় দাও। দেখে নিও, আমি কখনো তোমার অমর্যাদা হতে দিবো না, হারিয়ে যেতে দিবো না জীবন থেকে, তোমাকে ছাড়া যে, আমি ভালো থাকতে পারবো না সোনা,
নীরবতা ভেঙ্গে কাঁদোকাঁদো গলায় শফিক স্নিগ্ধার হাতদুটো নিজের হাতে নিয়ে আপন মনে কথাগুলো বলতে থাকে।
-- আমিও যে তোমায় ছেড়ে থাকতে পারবো না,
নবযৌবনের প্রভাতবেলায়,
পেয়েছি তোমায়,
ভালোবাসার দীপশিখা,
জ্বলে উঠেছিলো তোমার স্পর্শে,
আমার রক্তের প্রতিটি কণায়
মিশে আছো তুমি,,,,,
বলো আমায় ছেড়ে চলে যাবে না তো -- কাঁদতে থাকে স্নিগ্ধা।
--- অসম্ভব, কিভাবে ছেড়ে যাবো তোমায়,,, বলো,,,? দেখো আমি ফিরে আসবোই, আমার বেঁচে থাকার তাগিদে হলেও, তোমাকে আমার চাই,,,, কথা দিলাম ,, সারাজীবন পাশে থাকবো তোমার।
প্রিয়তমা,
জীবন সংকটের চরম মুহূর্তে
আশার বাণী হয়ে এসেছো তুমি,
হতাশা আর নিভুনিভু জীবনে,
এসেছো আলোকবর্তিকা হয়ে ।
জীবন সমুদ্রের মাঝে বদ্ধ জীবনে,
তুমি এসেছো নিঃশ্বাস হয়ে।
তুমিই শিখিয়েছো জীবনের মানে,
অকৃত্রিম ভালোবাসার ছোঁয়ায়।
বাঁচতে শিখিয়েছো তুমি
অনাগত জীবনে রঙীন স্বপ্নের,
হাতছানি দিয়ে।
তাইতো, তোমায় ছেড়ে যাবো না,
যাবো না কোনদিন ঐ সুদূর পানে,
তুমি শুধু আগলে রেখো প্রিয়তমা,
তোমার আঁচলে ভালোবাসা মেখে,,,,,
শফিক, স্নিগ্ধার বড় ভাই আজমলের বন্ধু, ঢাকা সিটি কলেজে পড়ালেখা করতো দুজন। শুধু তাই নয়, দুজনেই একই রাজনৈতিক মতাদর্শের হওয়ায় অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলো তাদের বন্ধুত্ব। সে সুবাদে প্রায়ই স্নিগ্ধাদের বাসায় যাওয়া- আসা ওর। স্নিগ্ধা পড়তো ইডেনে এইচ,এস,সি দ্বিতীয় বর্ষে। মাঝেমাঝে পড়ালেখা দেখে নিতো শফিকের কাছে,, এভাবেই ওদের পরিচয়, তারপর কাছে আসা, ভালোবাসা।
কিন্তু বড়ভাই আজমল ও বাড়ির কেউ এ সম্পর্কটাকে মেনে নিতে পারছিলো না, তারা কোন রাজনীতিবিদ ছেলের সাথে স্নিগ্ধার বিয়ে দিতে চান না।
অনেক ছোটবেলায় স্নিগ্ধার বাবা মারা যান, মা ভীষন কষ্ট করে ছয় ভাইবোনকে মানুষ করেছেন, স্নিগ্ধা সবার ছোট, পরে বড়ভাই ওকালতি শেষ করে সংসারের হাল ধরেন, দায়িত্ব নেন সবার, তিনিই লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন স্নিগ্ধাদের, খুব স্নেহ করেন ছোট বোনকে। তাই স্নিগ্ধা তাদের অবাধ্য হতে পারেনি কখনও, পারেনি মুখের উপর কোন কথা বলতে।
এইচ,এস,সি, শেষ করেই স্নিগ্ধাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পরে সবাই, পাত্রও দেখতে শুরু হয় তার। এক সময় পরিবারের কথা চিন্তা করে, নিজের ভালোবাসাকে জলাঞ্জলী দিয়ে বিয়ের পিড়ীতে বসতে হয় তাকে।
রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে, শফিক বিদেশ চলে যাওয়ার তিন মাসের মাথায় স্নিগ্ধার বিয়ে হয়ে যায়। তখন তো আর এখনকার মতো মোবাইল ফোন ছিলো না, ছিলো না ফেসবুক, চ্যাটিং, তাই স্নিগ্ধা জানাতে পারেনি শফিককে,,,
বিয়ের ঠিক এক বছর পর শফিক ঠিকই তার কথা রাখে, সে এখন প্রতিষ্ঠিত। বিদেশ থেকে ফিরে সরাসরি স্নিগ্ধাদের বাসায় চলে আসে সে, স্নিগ্ধার ভাবীর কাছে জানতে পারে তার বিয়ের কথা। আকাশ ভেঙ্গে পড়ে তার মাথায়, দম বন্ধ হয়ে আসে, পা অসার হয়ে যায় । বসে পড়ে সোফায়,,, চোখের জল আটকাতে পারেনা সে। পরে ভাবীর কাছে ঠিকানা নিয়ে স্নিগ্ধার সাথে একদিন দেখা করে।
--- তুমি কেমন করে পারলে সোনা, আমায় ছেড়ে যেতে? কত ভালোবেসেছিলাম তোমায়, অথচ,,,, আজ,,, বলেছিলে আমিই তোমার প্রথম প্রেম,,, তোমায় যেনো ছেড়ে চলে না আসি,, রাগে আর কান্না জড়িত কন্ঠে কথাগুলো বলে শফিক।
---- আমার কিছুই করার ছিলো না, মা অসুস্থ, বড় ভাইয়ের চাপ, আমি নিতে পারিনি,,, তাই,, তাদের কথা মতো আমায় বিয়ের পীঁড়িতে বসতে হয়,,,
আমায় ক্ষমা করে দিও তুমি,,,,
------ ক্ষমা! ভালোই বলেছো,, তোমার জন্যই রাজনীতি থেকে দূরে সরে বিদেশে গিয়েছি,,,,, শুধু তোমায় পাওয়ার আশায়,,, তুমি কথা রাখলেনা,,, আর কটা দিন কি সময় দিতে পারতে না আমায়,,,,,,,,,?
----- এভাবে বলো না, মেয়েদের জীবন বড়ই অদ্ভুদ, এ জীবনের রিমোর্ট থাকে পরিবারের হাতে, তারা যখন যেমন চায়, সেভাবেই চলতে হয়।
একটা কথা রাখবে তুমি?
---------- ভেঁজা চোখে তাকায় শফিক,,, বলো,,, কি বলতে চাও,,,?
---------- আর কখনও আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করো না, শশুরবাড়ির লোকজন ভালো চোখে দেখবে না, আমি সুখেই আছি, পারলে তুমিও বিয়ে করে সুখি হও, দোয়া করি আমি।
কোনকিছু না বলেই শফিক বাসা থেকে বেড়িয়ে পড়লে, সময়ের প্রয়োজনে ধাতস্ত জীবনেও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে স্নিগ্ধা , নিজেকে অপরাধী লাগে তার।
ডায়রিটা বন্ধ করে, জানালা দিয়ে আলো নিভে আসা আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘঃশ্বাস ছাড়ে সে। স্নিগ্ধা আজ জীবনের পড়ন্তবেলায় হিসেব কষতে শুরু করে, ভাবতে থাকে ---
আচ্ছা জীবনে কি পেলাম আমি? আমি কি পারতাম না বাড়িতে বোঝাতে কিংবা বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে? অথচ পারলাম না কেনো?
,, , হয়তো বাড়ির সবার প্রতি সম্মান ছিলো, দায়িত্ব ছিলো, তাই হয়তো কষ্ট দিতে পারিনি তাদের। ভাগ্যের অদৃষ্ট লিখন, খন্ডাবো কেমন করে?
স্বামী সন্তান সংসার সবই আছে আমার, স্বামীর ভালোবাসায় আমি পরিপূর্ণ, কখনও আদর সোহাগে কার্পণ্য করেনি সে, বিয়ের প্রায় চল্লিশ বছর হয় গেলো, কখনও ধমক দিয়ে কথা বলেনি পর্যন্ত। অথচ তারপরও কেন? কেন মনের ভিতর শুন্যতা বোধ হয়? কেন মনে পড়ে শফিককে,,, তাহলে কি এখনও ভালোবাসি তাকে,,, চোখ ঝাপসা হয়ে আসে তার। চশমাটা খুলে আলতো করে মুঝে নেয় সে। কষ্টগুলো কবিতা হয়ে আসে তার ----
যদি আর একটিবারের জন্য হলেও,
প্রিয়তম ফিরে আসতে তুমি ,
যদি দেখা হতো আবার,
তবে হয়তো,
নতুন জীবন ফিরে পেতাম ,
মনের শূন্যতাগুলো ভরিয়ে নিতাম,
তোমার ভালোবাসার উষ্ণতায়।
স্বামী সন্তান সংসার, এই সমাজকে,
ডিঙ্গিয়ে হয়তো বা তোমার
কাছে যেতে পারতাম না,
কিন্তু খানিক সময় তো,
হারিয়ে যেতে পারতাম,
পারতাম নির্জন কোন বনে,
একসাথে পাখির গান শুনতে,
হয়তো পারতাম শেষ বিকেলে,
রেললাইনের ধারে বসে,
কষ্টের গল্পগুলো শোনাতে,,,,,,
Page No 1