writerfair

জীবন থেকে নেওয়া

taken from life

Ziaur Rahman linkon

রাত তেমন একটা হয়নি, কেবল নয়টা বাজে মাত্র। চারদিকে গাড়ির হর্ণ, মানুষের কোলাহল, হকারের চিৎকার শোনা যাচ্ছে, এইতো কিছুক্ষণ আগে রাতের একটি ট্রেন হোসহোস করে হুইসেল বাঁজিয়ে চলে গেলো ঢাকা ছেড়ে। পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে, ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে জ্যোৎস্নার আলো আসছে, নাকি রাস্তার ধারের সোডিয়াম বাতির আলো,  ঠাঁহর করা যাচ্ছে না।

ভাঙা টিনের তৈরী বদ্ধ ঘরে তেল চিটচিটে খাটের উপর শুয়ে জ্বরে কাতরাচ্ছে জহির । তার একমাত্র ছেলে রতন বাবার সেবায় ব্যস্ত। ছোট হাতে অজানা আশঙ্কায়, মাঝে মাঝেই জলপট্টি মাথায় দিয়ে দিচ্ছে জহিরের। বাবাকে সে ভীষন ভালোবাসে, এই জহিরই তার বাবা-মা, ভাই-বোন, বন্ধু।

নিন্মবিত্ত, সে এক পরম জ্বালা, সারাদিনে পরিশ্রমে  লবনাক্ত ঘামে ভেঁজা জামা সাবান কিংবা ডিটারজেন্ট কিনতে না পারায় ঘুমাতে হয় তেল চিটচিটে কালো বিছানা বালিশে। অন্ন জোটে না পেটে যদি কাজ না জোটে। চিকিৎসা নেই তাদের। মোরের দোকানের গজেন কম্পাউন্ডারই তাদের শেষ ভরসা। ভাগ্যদেবীর চোখ পড়ে না এখানে, তার চোখতো গুলশান বাড়িধারাতে।চকচকে মার্বেল পাথর আর টাইলস দেখে ভাগ্যদেবী সেখানে প্রসন্ন হাসি হাসে। তার একদম খেতে ইচ্ছে করে না, জ্বিবায় স্বাদ পায় না সে, দুদিন থেকে শুধু শুকনো রুটি পানিতে ভিঁজে খাচ্ছে।

রতনের দিকে মায়াবী চোখে তাকিয়ে থাকে জহির। দীর্ঘঃশ্বাস ছাড়ে একটা, নিজের জীবনের কথা, রতনকে পাওয়ার কথা ভাবতে থাকে সে। প্রায় ত্রিশ বছর আগে, জহির কুড়িগ্রামের উলিপুর থেকে ঢাকায় চলে আসে, সেও এক করুন ইতিহাস।  তার বয়স তখন আর কত হবে!  হয়তো তেরো কিংবা চৌদ্দ বছর।

নদী ভাঙনের কবলে পড়ে, জমি জায়গা সব হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পরে তার বাবা, অনেক সন্তানের খাবার জোগাতে হিমশিম খান তিনি। বাবার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে, একদিন বাড়িতে কাউকে না বলেই ঢাকাগামী খালেক গাড়িতে উঠে সে। গাড়িতে সুপারভাইজারকে তার কষ্টের কথা জানালে , সুপারভাইজার ঢাকায় গিয়ে, তার পরিচিত এক ট্রাক ড্রাইভারের কাছে তুলে দেয় তাকে, সেখান থেকেই জীবন চলার পথ শুরু। 

ওস্তাদের সাথেই কমলাপুর স্টেশন বস্তিতেই সে থাকা শুরু করে। ধীরে ধীরে ট্রাক চালানো শিখে ফেলে, পরে ওস্তাদ সিটি কর্পোরেশনের ময়লা ফেলা একটা ট্রাকে তার চাকুরির ব্যবস্থা করে দেন।

জহির অত্যন্ত সৎ ও কর্মোঠ হওয়ায় ওস্তাদ তার মেয়ের সাথেই জহিরের বিয়ে দিয়ে দেন। বেশ ভালোয় কাটছিলো তার, কিছুদিন পর বউয়ের পেটে বাচ্চা আসে, অনাগত সন্তানকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে সে। কিন্তু ভাগ্য যার সহায় নয়, তারতো স্বপ্ন দেখা নিষেধ। চাঁদ রাতেই যেনো অমাবস্যাতিথি জেঁকে বসে তার ঘরে।

সন্তান প্রসব হতে গিয়ে অ্যাকলেমশিয়ায় আক্রান্ত  তার বউ বাচ্চাসহ মারা যায়, সেই থেকে  জহির বিয়ে না করে একাই থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রতিদিনের মতোই জহির শহরের ময়লা ফেলতে বুড়িগঙ্গা নদীর এদিকে আসে। হঠাৎ তার কানে একটি ছোট বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনতে পায়। একটু খোঁজাখুঁজির পরেই সে আবিস্কার করে, পলিথিনে মোড়ানো সদ্য জন্ম নেওয়া এক ফুটফুটে ছেলে বাচ্চাকে। পিঁপড়ের কাঁমড় আর সদ্য প্রসূতি মায়ের জন্য আকাশ বিদারী কান্না করছে সে। হয়তো ক্ষিধের জ্বালায় পেট জ্বলছে শিশুটির। এগিয়ে যায় সে, সহকারী কন্ট্রাকটর তাকে ঝামেলায় জড়াতে নিষেধ করেন, তবুও জহির শিশুটিকে কোলে তুলে নেয়-

 হায়রে মানুষ, জানোয়ারের চেয়েও এতো অধম হয় কি করে? বুকটা কান্নায় ভারী হয়ে আসে জহিরের। নিজের মরা সন্তানের কথা মনে পড়ে তার। সভ্য শিক্ষিত মানব মানবীর, নোংড়া প্রেমের ফসল, কয়েক মিনিটের দৈহিক লালসাপূর্ণ ক্রিয়ার, প্রতিক্রিয়া এই মানব শিশু। হে অশ্লীলতায় নেশাচ্ছন্ন মানুষ, তোমাদের চেয়েও, বনের নিকৃষ্ট প্রাণি, সেও ঢের ভালো। সেতো তার গর্ভজাত  ন্তানকে ফেলে আসে না কোন ডাস্টবিনে কিংবা নোংড়া আবর্জনার মাঝে। অথচ তুমি তো বিবেকবান, শিক্ষিত সমাজের, শিক্ষিত মানুষ, তবে কেমন করে পারো তুমি, এ নৃশংস খেলায় মাততে ? কেমন করে পারো তুমি, গর্ভজাত সন্তানকে ফেলে দিতে, সেতো তোমারই দেহের অংশ। যদি নাই পারো, ধরে রাখতে তারে, তবে কেনো দেহের ক্ষুধা মেটানো, কেনই বা তোমার, প্রেমের নামে শরীর নিয়ে খেলা! তোমাদের চেয়ে বোধ হয় নিষিদ্ধ পল্লীর গাঢ় লিপস্টিক দেওয়া পতিতাও ভালো ;

বাড়িতে নিয়ে আসে তাকে, সেই থেকে জহিরই তার বাবা, জহিরই তার মা। অনেক কষ্ট করে বড় করে রতনকে। এখন তার সমস্ত কিছু রতনকেই ঘিরে। তার সুখ, শান্তি, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবকিছু রতনকে নিয়েই। রতন যখন তাকে বাবা বলে ডাকে, খুশিতে ভরে উঠে তার মন, চোখে ভাসে চিকচিক করা আনন্দের জল। এখন সে বাঁচতে চায় রতনকে নিয়েই।

ট্রাক চালানো ছেড়ে দিয়েছে কয়েক বছর আগে, দিনরাত শুধু পরিশ্রম করতে হয়, রতনের যত্ন নিতে পারে না তেমন একটা। তাই সে এখন লেগুনা ভাড়ায় চালায়। রতনকে একটা পথশিশু স্কুলে ভর্তিও করে দিয়েছে জহির। পড়ালেখার ফাঁকে বাবাকে সাহায্য করে রতন ।

জহির স্বপ্ন দেখে, একদিন তাদের একটা বাস হবে, বাবা ছেলে মিলে চালাবে সেই বাস। তাইতো সঞ্চয় করছে সে।

-- বাবা, দু'দিন থ্যাইকা শুধু শুকনা রুডি খায়া আছো, একটু ভাত খায়া লও। মা থাকলে এ রকম না খায়া থাকতে দিতো না তোমারে।

ছেলের কথায় সম্বিৎ ফিরে পায় জহির। বুকে টেনে নেয় রতনকে,  আর বুক ভেদ করে বের হওয়া কান্নায় হুহু করে কাঁদতে থাকে সে।

Page No 1