writerfair

মৌনতা ও এককাপ চা

Silence and a cup of tea

Wahid Zaman

প্রথম অংশ

গত কয়েকদিন ধরে মৌনতার মন খারাপ। কোন কাজে তার মন বসছে না। এমনটা মাঝে মাঝে তার হয়। কিন্তু এবার বোধহয় একটু দীর্ঘ সময় মৌনতার মন খারাপ। আবীর গোপনে অনেক চেষ্টা করে যাচ্ছে, কেন মৌনতা মাঝে মাঝে এমনটি করে। কিন্তু হিসাব মেলাতে পারছে না।
আবীরের সাথে মৌনতার বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর হলো। পারিবারিক বিয়ে। আবীর মৌনতাকে নতুন করে আবিষ্কার করার চেষ্টা করে যাচ্ছে গত পাঁচ বছর ধরে। কিন্তু মৌনতাকে সে ঠিক সেভাবে চিনতে পারেনি। আবীর তার বিয়ের আগের জীবনের সব বিষয় মৌনতাকে বলেছে। সৃজনীর সাথে তার প্রেম, তার সাথে বহুবার গোপন অভিসারে যাওয়া ইত্যাদি। কিন্তু মৌনতা কোন কিছুতে কোন অভিমান বা অভিযোগ করেনি। কখনো এসব উদ্বুদ্ধ প্রসঙ্গ তুলে আবীরকে খোটা দেয়নি। বরং বলে, এসব মানুষের জীবনে হতেই পারে। বর্তমানে ভালো থাকাটা তার কাছে মূখ্য। অথচ মৌনতা তার ব্যক্তিগত জীবন অর্থাৎ বিয়ের আগের জীবন সম্পর্কে আবীরকে কখনো কিছু বলেনি। আবীর ভাবতো, সে নিজে যেমন অকপটে মৌনতাকে সব বলেছে, মৌনতাও তেমনটি করবে। কিন্তু গত পাঁচ বছরের দাম্পত্য জীবনে মৌনতা তার কিছুই করেনি। অবশ্য আবীর যথেষ্ট উদার। সে ভাবে, মৌনতার জীবনে হয়ত তার মতো তেমন কোন ঘটনাই নেই।


আজ আবীর অফিস থেকে বাসায় ফিরে দেখে মৌনতা বাসায় নেই। প্রথমটায় তেমন কিছু মনে হয়নি। ক্রমশ যখন সময় গড়াতে লাগলো, আবীর উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। মৌনতাকে ফোন করেছে কয়েকবার কিন্তু ফোন বন্ধ। কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। একবার ভেবেছিল মৌনতার মাকে অর্থাৎ শাশুড়ি মাকে ফোন করে জানবে মৌনতা ওখানে আছে কিনা। কিন্তু পরক্ষণে ভাবল, যদি মৌনতা ওখানে না যায়, তাহলে বিষয়টি অন্য রকম হবে। সবাই দুশ্চিন্তায় পড়ে যাবে। তারচেয়ে অপেক্ষা করা ভালো।
রাত এগারোটায় মৌনতা বাসায় আসে। বাসায় রাতের কোন খাবার রান্না ছিল না। আবীর নিজেই রাতের খাবার রান্না করেছে। আবীর মৌনতার কাছে ছুটে যায়। এতক্ষণ কোথায় ছিল জিজ্ঞেস করে। মৌনতা কোন উত্তর দেয় না। শুধু এতটুকু বলে, ভীষণ মাথা ব্যাথা করছে, আমি এখন ঘুমোবো।
আবীর ভীষণ কষ্ট পায় মৌনতার কথা শুনে। সন্ধ্যা ছয়টায় অফিস থেকে আসার পর থেকে মৌনতাকে বাসায় না পেয়ে, কী দুশ্চিন্তার ঝড় তার মাথার উপর দিয়ে বয়ে গেছে, এসবের কোনো মূল্য মৌনতার কাছে নেই?
আসলে জগৎ অনেক কঠিন জায়গা। এখানে সবসময় সব হিসাব নিজের মতো করে হয় না।
মৌনতাকে ঘিরে আবীরের দুশ্চিন্তা বাড়তে লাগলো। কী করবে, কী করলে মৌনতাকে নিজের মতো করে পাবে, সারাক্ষণ এসব চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। কোন কাজে তার মন বসছে না। কিন্তু একটা বিষয়, আবীর একটি বারের জন্য মৌনতাকে ভুল বোঝেনি। তার একটাই ভাবনা, কেন মৌনতা এমন করছে, কেন সে


আগের মতো স্বাভাবিক নেই? তার ভাবনা, সমস্ত রহস্য তাকে খুঁজে বের করতে হবে। কারণ মৌনতাকে সে অনেক বেশি ভালোবাসে। তাকে ছাড়া তার জীবন অর্থহীন।
কয়েক দিন এভাবে কেটে যায়। আবীর সারাক্ষণ মৌনতাকে আবিষ্কার করার চেষ্টায় ব্যস্ত। অফিসের কাজকর্মে ইদানিং তার ভুল হয়। সে নিজেও কিছুটা বিস্মিত। তার কেন এমন হচ্ছে। আসলে ভালোবাসার মানুষ কষ্টে থাকলে এমনটা হতে পারে। এমনি মিথ্যা প্রবোধ দিয়ে নিজেকে শান্ত্বনা দেয় আবীর।

*
অফিসের মেগা প্রজেক্ট নিয়ে অনেক ব্যস্ত সময় পার করছে আবীর। তাই মৌনতাকে ফোন করে খোঁজখবর নিতে ইদানিং ভুলে যায়। কিন্তু আবীর অবাকও হচ্ছে। আজ হঠাৎ মৌনতা তাকে ফোন করে আগেভাগে অফিসের কাজ সেরে বাসায় যেতে বলেছে। আবীর তাই অনেকটা উৎফুল্ল। এটা যে মৌনতার নতুন আচরণ তা নয়। সেতো নিয়মিত আবীরের খোঁজখবর নিত। কিন্তু কিছু দিন এই নিয়মের বিপত্তি ঘটেছিল। আজকের ফোন পাওয়ার পর থেকে আবীর যেন নতুন করে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে পেয়েছে।
অফিস থেকে আসার পর মৌনতাকে প্রফুল্ল দেখে আবীরের খুব
ভালো লাগে। তার হাসিমুখ সবসময় দেখতে চায় আবীর। তার মলিন
মুখ দেখলে তার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। আবীরকে দেখে
মৌনতা কাছে ছুটে যায়। অকস্মাৎ তাকে জড়িয়ে ধরে। আবীর কিছু
বুঝে উঠার আগেই তাকে চুমোয় চুমোয় ভরে দেয় মৌনতা। আবীর
বলে, আমি ফ্রেস হই আগে, তারপর...।
মৌনতা কিছুই আমলে নেয় না। এক আদিম প্রবৃত্তিতে মেতে ওঠে সে। আবীরও বাধা দেয় না। তারপর দুজন দুজনকে ক্রমশ আবিষ্কার করে চলে।
আবীর আর মৌনতার যেন নতুন সংসার। হঠাৎ করে নতুন কেউ দেখলে বুঝতেই পারবে না যে তাদের দাম্পত্য জীবন প্রায় পাঁচ বছরের বেশি। আগের চেয়ে তারা এখন আরো বেশি আপন, আরও বেশি ভালোবাসে। আবীর মৌনতার এই পরিবর্তনের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দেয় আগের চেয়ে বেশি। তাদের ভালোবাসার এ মধুমাখা রঙ নতুন নয়। কিন্তু কেন জানি আগের চেয়ে প্রবল ও গভীর।
এভাবে কেটে যায় কয়েক মাস। মৌনতার আর আগের মতো মন খারাপ থাকে না। নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড়ে তুলেছে সে। দিনের প্রতিটা মুহূর্ত সে আবীরকে নিয়ে ভাবে। আবীরই তার ধ্যান জ্ঞান। আবীর তা বুঝতে পারে কিন্তু কিছু বলে না। শুধু মৌনতার ভালোবাসায় নিজেকে প্রতিদিন একটু একটু করে আবিষ্কার করে। ভালোবাসার সাতরঙে নিজেকে রাঙায়।


*


একদিন হঠাৎ মৌনতার একটা ডায়েরি আবীরের চোখে পড়ে। আবীর ডায়েরিটা লুকিয়ে রাখে। খুব নির্জনে ডায়েরিটা পড়বে বলে চিন্তা করে। আবার এও ভাবে, কারো ব্যক্তিগত ডায়েরি তার অজান্তে পড়া ঠিক নয়। হোক মৌনতা তার স্ত্রী। তারওতো নিজস্ব কিছু বিষয় থাকতে পারে। মৌনতার অনুমতি ছাড়া তার ডায়েরি পড়া নিছক অন্যায় হবে। আবার এটাও ভাবে মৌনতার মানসিক বেদনার কারণ এ ডায়েরিতে থাকতে পারে। তার বেদনার কারণ জানা থাকলে তাকে বুঝতে সহজ হবে। এসব সাতপাঁচ ভেবে আবীর মৌনতার ডায়েরিটা অফিসের ব্যাগে লুকিয়ে রাখে, অফিসের কাজের অবসরে পড়ার জন্য।
পরদিন অফিসে মৌনতার ডায়েরিটা পড়তে থাকে। যত পড়ে তত মৌনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠে আবীর। ডায়েরির প্রতিটা পাতা জুড়ে আবীরের প্রশংসা। আবীরের মন খারাপ হলে মৌনতার কিছুই ভালো লাগে না তা ডায়েরির পাতায় পাতায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আবীর ধীরে ধীরে ডায়েরির পাতায় নিজের নতুনরূপ দেখতে পায়। যে রূপের কারিগর হচ্ছে মৌনতা।

এভাবে আবীর ডায়েরির প্রায় শেষ প্রান্তে এসে পড়ে। হঠাৎ আলাদা কয়েকটি পাতা ভাঁজ করা অবস্থায় পায়। বিশেষ আগ্রহ নিয়ে সে পাতাগুলো খোলে। নীল কালি দিয়ে লেখা কিছু কথা। পড়া শুরু করে এবং মৌনতার বিশেষ কয়েকদিনের মন খারাপের কারণ নির্ণয় করতে সক্ষম হয়। সেখানে লেখা আছে-
আমার মরতে ইচ্ছে করে কিন্তু আমি তা করতে পারব না। আমি মরলে আমার আবীরের কি হবে। আমি কেন এমন অলক্ষুণে ভাবনা ভাবি, তার একটা কারণ আছে বৈকি। আজ আমার পুরনো প্রেমিক রাসেল এর সাথে দেখা হলো দীর্ঘ সাত বছর পরে। আমার বিয়ের দুই বছর আগে রাসেল স্কলারশিপ পেয়ে লন্ডন চলে যায়। যাওয়ার আগে কথা ছিল আমাদের প্রতিদিন কথা হবে, যোগাযোগ হবে। প্রথম কয়েক মাস কথা হতো। তারপর ধীরে ধীরে রাসেল বদলে যায়। একসময় যোগাযোগ একেবারে বন্ধ করে দেয়। আমি অনেক বার রাসেলকে ফোন করেছি কিন্তু রাসেল কথা বলত না। নিজেকে অনেক ছোট মনে হতো। তাই একসময় আমিও যোগাযোগ বন্ধ করি।
দীর্ঘ সাত বছর পরে রাসেল এর সাথে দেখা। কিন্তু সে আমাকে চিনতেই পারল না। সাথে স্ত্রী ছিল বলে আমি কোন কথা বাড়ায়নি। শুধু একটু বলেছিলাম, কেমন আছ রাসেল? সে না শোনার ভান করে চলে যায়। অথচ একসময় ইউনিভার্সিটি লাইফে সে আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না। বেকার রাসেল আমাকে রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে পারত না বলে লজ্জা পেত। আমি তাকে বিষয়টি সহজ করে দেই। বলি, তোমার চাকুরী না হওয়া পর্যন্ত আমি তোমাকে রেস্টুরেন্টে খাওয়াবো। তুমি যখন প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন সুদেআসলে সব শোধ করে দিও। রাসেল হাসত।
রাসেল রেস্টুরেন্টে তেমন কিছু খেতো না। শুধু এক কাপ চা। আমি অনেক রাগ করতাম। তখন বলত, তোমার এই এককাপ চা আমার কাছে ঢের বেশি। রাসেল অনেক মেধাবী ছিল। সে তার ডিপার্টমেন্টে সর্বোচ্চ রেজাল্ট করে এবং যথারীতি স্কলারশিপ পায়। তারপর তো ইতিহাস....

লন্ডন যাওয়ার আগের দিন আমরা দেখা করি। রাসেল কে দেখে সেদিন মনেই হয়নি, একসময় সে একেবারে বিপরীতমুখী একজন মানুষ হবে। ঐ দিন বলেছিলাম কি খাবে? উত্তরে বলেছিল, আমার মৌনতা থাকলে কিছু লাগে না আর সাথে এককাপ চা। আমার খুব হাসি পেয়েছিল। ওদিনও সে এককাপ চা ছাড়া আর কিছুই চায়নি।
আজকে খুব কষ্ট হয়, মানুষ এমন কেন করে। রাসেলের আলাদা একটা জীবন আছে, তাতো আমি অস্বীকার করি না। এখন চাইলেই তার সাথে আগের মতো অবাধে মেশা যাবে না। কিন্তু মানুষ যেমন আত্মীয় বা বন্ধুর সাথে দেখা হলে কুশল বিনিময় করে, ততটুকু তো রাসেল করতে পারত। মানুষের জীবনে এমন যেন কোন বন্ধু বা কাছের কেউ না থাকে, যে কিনা জীবিত হয়েও মৃত। রাসেল তোমাকে একেবারে মুক্ত করে দিলাম। যতটুকু হৃদয়ে ধরে রেখে ছিলাম, তা আজ ধুয়ে মুছে সাফ করে দিলাম। ভালো থেকো রাসেল। মনে রেখ, আমার একজন আবীর আছে... বিদায়।
লেখাটা পড়ে আবীরের চোখে জল এসে গেল। মৌনতার মানসিক অস্থিরতার কারণ আবিষ্কার করল। আবীরও অস্থির হয়ে উঠলো মৌনতার জন্য। সাথে সাথে মৌনতাকে ফোন করলো। বলল, আজ সন্ধ্যায় আমরা রেস্টুরেন্টে খাব এবং তুমি আমাকে খাওয়াবে।
শুনে মৌনতা হাসল। জানতে চাইল হঠাৎ তাকে কেন খাওয়াতে হবে।
আবির বলল, সবসময় তো আমি খাওয়াই। মৌনতা বলল, ঠিক আছে।
আবীর আর মৌনতা রেস্টুরেন্টে যায়। কিন্তু মৌনতা একটু হোঁচট খায়। আবীর যে রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসেছে, এটা মৌনতার অনেক পরিচিত। এখানে সে আর রাসেল একসময় প্রতিদিন আসত।
ওরা রেস্টুরেন্টের নির্জন একটা টেবিলে বসে। দুজন নীরব থাকে। মৌনতা নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করে, কী খাবে?
কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবীর বলে, আমার মৌনতা থাকলে কিছু লাগে না আর সাথে এককাপ চা। একথা শুনে মৌনতা আচমকা লাফিয়ে ওঠে। সে মনে করে আবীর তাকে তিরস্কার করছে। আবীর বিষয়টি বুঝতে পারে। বিলম্ব না করে মৌনতাকে বলে, আমিতো তোমার আবীর, রাসেল নই। তোমার সবকিছুতে আমি থাকতে চাই মৌনতা।
মৌনতা অবাক হয়ে যায় আবিরের ভালোবাসায়। মুগ্ধ নয়নে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। আবিরের চোখে নিজেকে স্পষ্ট দেখতে পায়। চোখের গভীরে এক নিখাদ বিশ্বাসের আশ্বাস পেয়ে ভালোলাগার আবেশে মৌনতা ভেসে যায় কিছুক্ষণ। তারপর তারা শহরের চেনা অচেনা রাস্তায় দীর্ঘক্ষণ রিকশায় ঘোরে এবং অনেক রাতে বাসায় ফেরে।

Page No 1