writerfair

ফুলবানু

Fulbanu

Wahid Zaman

n/a

জয়নব মারা যাওয়ার পর ফরিদ আর বিয়ে করেনি। সাত বছরের ছেলে আসলামকে নিয়ে তার সংসার। গ্রামের অনেকে ফরিদের সংসার পাতার তাগিদ দেয় কিন্তু ফরিদের একটাই কথা সে আর বিয়ে করবে না। তার মনে হয়, সংসার পাতলে কোথাকার কোন অচেনা মেয়ে ঘরে বউ হয়ে আসলে, মা মরা ছেলে আসলামের কি হবে। তাছাড়া জয়নব মরার আগে ফরিদকে বলত, ওগো আসলামের বাপ, আমি বোদায় আর বেশি দিন বাচতিচিনে। আমি মল্লি আমার ছেলিডার কি হবে?

জয়নবের কথা শুনে ফরিদ বলত, হ্যাতো অলক্ষুণে কতা চিন্তা করিস ক্যানরে বউ। তোর কিচ্ছু হবে না। দেকবি আল্লাহর রওমতে তুই সুস্থ হুয়ি ওঠবি।

আমি ঠাহর করতি পাত্তিচি। আমার দিন শেষ হুয়ি আসতিচে।

এসব বাজে কুতা আর মুখে আনবিনে।

আমার এট্টা কুতা রাকবা?

কী কুতা?

আমি মুরি গেলি, তুমি আমার আসলামরে কোলে আগলে রাকবা। তুমি যদি বেখেয়ালি হও, আমার আসলাম বানের জলে ভেসি যাবে।

ফরিদ আর ভাবতে পারে না। জলে চোখ ভিজে আসে। আসলামকে স্কুলে যাওয়ার ব্যাবস্থা করে লাঙ্গল জোয়াল কাঁধে তুলে মাঠে যায়।

 

*

ফরিদ আর সেন্টু একসাথে দবির মেম্বার এর জমি বর্গা চাষ করে। গতবছর পাট চাষে এরা দুজন ভালো পয়সার মুখ দেখেছিল। সেই থেকে দুজনের মহা খাতির। গলায় গলায় মিশে চলে। সেন্টু ফরিদের প্রতিবেশী। ফরিদের বউ নেই বলে সেন্টুর বউ ফুলবানু ফরিদের দুপুরের খাবার মাঠে আনে। ফরিদ আর সেন্টু একসাথে খায়। সেন্টুর বউ ফুলবানু আসলামেরও খাবার দিয়ে আসে। মাস শেষে ফরিদ সেন্টুকে কিছু টাকা ধরে দেয়।

ইদানিং ফুলবানু ফরিদের একটু তোয়াজ বেশি করে। সেন্টুর অনুপস্থিতিতে মাঝে মধ্যে খোঁচা দিয়ে বলে, চাষী, তুমার ভারি অন্যায় হোচ্চে।

কী কও বুঝতি পাললাম না?

না বুঝার কিছু কলাম নাকি?

প্যাচ না দিয়ে খুলি কতি পার না?

খুলিই কতিচি। তুমিতো আবার সহজ কুতা প্যাচ ভেবি নেও। হুয়িচে, কি কতি চাচ্চিলে কও।

কতিছিলাম আর এট্টা বিয়ি কর।

ও বুচতে পারিচি।

তুমি দেকতি কিন্তু মাসসাল্লাহ মেলা ভালো। গাগতোরে তুমার মতোন আমাগের গিরামে কারোতো দেকিনে।

আমি বিয়ি করতাম না ফুলবানু।

মরোদ মানুস, বিয়ি না কল্লি থাকতি পারবা।

ফরিদ উত্তর দেয় না। ফুলবানু বুঝতে পারে ফরিদ শরম পাচ্ছে। তাই আর কথা বাড়ায় না। গামছায় বাঁধা খাবারের পোটলা রেখে চলে যায়।

ফরিদের হঠাৎ জ্বর আসে। চৈত্র মাসের খা খা রোদ্দুরে গত কয়েক দিন অমানুষিক পরিশ্রম করেছে ফরিদ। সেন্টু জরুরী কাজে গঞ্জে গেছে। ফরিদের উপর কাজের চাপ একটু বেশি ছিল। ফলে অসুস্থ হয়। সেন্টু ফিরলে সে একটু আঁচান পাবে। অবশ্য ফুলবানু ফরিদের সবসময় খোঁজখবর রাখে।

 

*

দু'দিন পর সেন্টু গঞ্জ থেকে ফিরে আসে। ফরিদ অসুস্থ বলে সেন্টু একাই মাঠের কাজ সামাল দেয়। ফরিদের সাথে সেন্টুর পরিবারের বন্ধন খুবই অটুট। প্রতিবেশী বলে নয়, ফরিদ আর সেন্টু বাল্যবন্ধু। তাদের সম্পর্ক এখন আগের চেয়ে বেশি গভীর। তার হেতু হলো ফুলবানু। ইদানিং ফুলবানু ফরিদ ও তার ছেলে আসলামের প্রতি অনেক যত্নশীল। মাঝে মাঝে সেন্টু এ ব্যাপারে কথা তোলে। বলে, তোর এট্টু বেশি বাড়াবাড়ি হুয়ি যাচ্চে, ফুলবানু।

ক্যান বাড়াবাড়ি হুতিচে। ওরা আমাগের পুতিবেশি। বিপদে

আপদে আমরা যদি ওগের পাশে না দাড়াই, মানসে কী কবে। আমি তো কিছু করতি মানা করতিচিনে। কিন্তু বেশি ভালোবাসা

দিকাতি গেলি, মানসে কত কুতা কবে তা ভেবি দেকিচিস।

একথা শুনে ফুলবানু কান্না করে। তার মন খারাপ দেখে সেন্টু কাছে আসে। বলে, কানতিচিস ক্যান। আমি কান্দার মতোন কিচু কলাম নাকি।

কানবো না। আমাগের বিয়ি হুয়িচে দশ বছর হুলো। আমি আজও মা হতি পারিনি। আসলামের জন্যি তো ও বাড়িতে আমি যাই। ওরে দেকলি আমার পরানডা এট্টু শান্তি পায়।

এবার সেন্টু চুপসে যায়। কারণ গঞ্জের ডাক্তার সন্তান না হওয়ার জন্য সেন্টুকে দায়ী করেছে। সমস্যা সেন্টুর, ফুলবানুর না। আর কোন কথা না বাড়িয়ে সেন্টু মাঠে চলে যায়।

মাঠে সেন্টুর কোন কাজে মন বসে না। শুধু ফুলবানুর একটা কথা তার কানে ভাসে, আমি মা হতি পারিনি...। আসলামের জন্যি তো ও বাড়িতে যাই।

সেন্টু ভাবে, আমার জন্যিতো ফুলবানু মা হবার পারলো না। ও যদি আসলামকে কাছে পেয়ি মাতৃত্বের সুখ পায়, তাতে বাঁধা দিতি হবে কেনো।

*

রাতের খাবার খাচ্ছিল সেন্টু আর ফুলবানু। ফুলবানুর মন খারাপ দেখে সেন্টু বলে, কিরে তুই এ্যানো মুখডা কালচে কুরি আচিস। কী করবো। আমার সুকির দিকে তুমার কোন খ্যাল ট্যাল আচে?

কীকতিচিস বউ। আমি কুনো চেষ্টা তদবিরের বাদ রাকিচি? ডাক্তার কুইচে আমি তোরে মা হবার স্বাদ দিতি পারব না। ইডা কি আমার হাতে?

সিডা জানি। আমাগের কপালডাই অলক্ষুণে কপাল।

কিন্তু...

কীকতি চাচ্চিস?

কিছু না

থামলি ক্যান বউ। কুয়ি ফ্যাল।

তখন ফুলবানু কাঁদে। সেন্টু কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। কাঁদতে কাঁদতে ফুলবানু বলে, দশ বছর তুমার সংসার কল্লাম, না পাল্লাম মা হতি না পালাম ভাতারের সুক।

সেন্টু লজ্জা ও অপমানে জড়োসড়ো হয়ে যায়। কোন কথা বলে না। গোগ্রাসে ভাত গিলতে থাকে।

হঠাৎ আসলাম কাঁদতে কাঁদতে আসে। ফুলবানু আসলামকে দেখে চিৎকার দিয়ে ওঠে। আসলামের কাছে ছুটে যায়। তখনো আসলাম ফুপিয়ে কাঁদছে। ফুলবানু আসলামকে জড়িয়ে ধরে। বলে, আমার বাপজান কান্দে ক্যান। কি হুয়িচে আমার বাপজানের।

আসলাম শুধু কাঁদে, কিছু বলতে পারে না। ফুলবানু আসলামকে আদর করে। সেন্টু ফুলবানুর এ আচরণে মুগ্ধ হয়। সেন্টুর নীরবতা দেখে ফুলবানু বলে, কই গো, চুপচাপ বুসি আচ ক্যান? আমার বাপজানের কি হুয়িচে এট্টু দেখ।

সেন্টু দ্রুত আসলামের কাছে আসে। আসলাম কাঁদতে কাঁদতে

বলে, আব্বা, কিরাম জানি কত্তিচে।

আর বলতে পারে না। ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে। ফুলবানু আর সেন্টু দৌড় দিয়ে ফরিদকে দেখতে যায়।

 

*

জ্বরে ফরিদের গা পুড়ে যাচ্ছে। ফুলবানু ফরিদের মাথায় পানি ঢালে। কিছুক্ষণ পরপর ভিজা ন্যাকড়া দিয়ে শরীর মুছে দেয়। ফরিদ ভুল বকতে থাকে। রাত গভীর হয়। ক্লান্ত আসলাম ঘুমিয়ে পড়ে। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর সেন্টুও ক্লান্ত। ফরিদের ঘরের বারান্দায় সেও ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু ফুলবানুর চোখে ঘুম নেই। সে ফরিদকে সেবাযত্ন করতে থাকে। ফরিদের জন্য ফুলবানু ভেতরে এক অজানা টান অনুভব করে। অসুস্থ ফরিদ দিকশূন্য হয়ে যায়। সমস্ত শরীরে চৈত্রের মাসের মতো দাহ শুরু হয়। কথা বলতে কষ্ট হয়। হাত ইশারা করে কি যেন বলে। মাঝে মাঝে অর্থহীন প্রলাপ বলে। ফুলবানু তাকে সাহস জোগায়। বলে, চাষী তুমার কিচ্ছু হবে না।

কিছু পরে ফরিদ ঘুমিয়ে পড়ে। জ্বর কিছুটা স্বাভাবিক হয়। ফুলবানুরও ঘুমে ধরে। সে ক্লান্ত শরীরে কখন যে ফরিদের পাশে ঘুমিয়ে পড়ে টের পায়নি। সকাল হয়ে আসে। পাখিদের কলরবে মুখরিত হয়ে ওঠে এক নতুন সকাল। ফুলবানুর ঘুম ভেঙে যায়। নিজেকে ফরিদের পাশে দেখে ঈষৎ লজ্জা পায়। দ্রুত উঠতে যায়। তখন বুকের উপর একটা চাপ অনুভব করে। ফরিদের হাত তার স্তন বরাবর লেপ্টে আছে। হঠাৎ সারা শরীরে পুলক অনুভব করে। কেন জানি ফরিদের হাতটা সরাতে ইচ্ছে হচ্ছিল না তার। নিজেকে সংযত করে সাবধানে সরিয়ে দেয় ফরিদের হাত। বাহিরে আসে। তখনো সেন্টু অঘোরে ঘুমাচ্ছে।

 

ফুলবানুর সেবাযত্নে ফরিদ সুস্থ হয়ে ওঠে। কিন্তু মাথার মধ্যে একটা চিন্তা ভর করে ফরিদের। বারবার সে ভাবে, ফুলবানু তারে এত তোয়াজ করে ক্যান। সে তার কি হয়। ক্যান তারে হ্যাত আপন লাগে।

আর ভাবতে চায় না ফরিদ। জয়নবের যায়গায় ফুলবানুর কথা ভাবতে কেন জানি তার ভেতরে বাধা দেয়।

ধীরে ধীরে ফুলবানুর সাথে ফরিদের মন দেয়া নেয়া চলে। ফরিদের চেয়ে ফুলবানু বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। কারণে অকারণে সে ফরিদের কাছাকাছি আসে। ফরিদের ভালো লাগে কিন্তু সমাজ ও লোকচক্ষুর ভয়ে সে নিজেকে সংযত রাখে। তাছাড়া সে সেন্টুর কথা ভাবে। সেন্টু ফরিদের কাছের বন্ধু। সে জানতে পারলে অনেক কষ্ট পাবে। কিন্তু ফুলবানু বেশ বেপরোয়া। তার এসব ভাবার সময় নেই।

 

*

একদিন সেন্টু এক জরুরি কাজে গঞ্জে যায়। ফিরতে দু-একদিন দেরী হয়। ফুলবানু এই সুযোগে রাতে ফরিদের বাড়িতে আসে। ফরিদ এটা ভালোভাবে নেয় না। সে বলে, কিরে ফুলবানু অসুমায়ে ক্যান আইচো। চাষী, তুমার বাড়িতে আসতে কি আমার বারন আচেনি।

তা কি আমি কচ্চি।

এওন কি কলে তুমি।

না মানে, মেলা রাত হুয়িচে তো তাই। তাছাড়া সেন্টু গঞ্জে।

ও বুচতে পারিচি। তুমি আমারে তাড়াই দিতি চাচ্চো।

কী যে কতিচাও ফুলবানু।

ঠিকই কতিচি। চাষী, তুমার ভয় পাবার কিছু নেই। আমি আমার আসলামরে এট্টু দেকতি আইচি।

ও আচ্চা। আসলামতো মেলা আগে ঘুমাইচে।

তাইলে যাই। তয় যাবার আগে তুমার এককান কুতা কুয়ি যাই।

কও-

তুমি কিন্তু মেলা ভিতু।

ফরিদ হাসে। সে বুঝতে পারে ফুলবানু তার জন্য আসে। মনে মনে তার মধ্যেও ফুলবানুর জন্য কামনার আগুন জ্বলতে থাকে। কিন্তু কী এক অজানা কারণে নিজেকে আড়ালে রাখে। ফুলবানু চলে যেতে উদ্যত হয়। হঠাৎ ফরিদ মুখ ফসকে বলে ফেলে, শুধু আসলামকে দেকতি আইচো, ফুলবানু।

ফুলবানু ঈষৎ কেঁপে ওঠে। ফরিদের কথার অর্থ বুঝতে পারে। তাই সেও নানান ছুতোয় সময় পার করে। ফরিদও কিছুটা স্বাভাবিক হয়। লাজ সমরের মাথা খেয়ে ফুলবানু বলে, চাষী তুমার পাশে এট্টু বসি।

ফরিদ কিছু বলে না। তার চোখে মুখে এক অন্যরকম ফরিদকে দেখতে পায় ফুলবানু। ফরিদের অনুমতির অপেক্ষা না করে বসে। নানান প্রসঙ্গ তুলে ফরিদের মনভোলানোর চেষ্টা করে ফুলবানু। সময় গড়াতে থাকে। এদিকে আকাশ জুড়ে ঘনকালো মেঘ জমে যায়। বিদ্যুৎতের তীব্র ভৎসনা চিরে চিরে ফেলে শূন্যতাকে। হঠাৎ বিকট শব্দে বিদ্যুৎ চমকায়। আচমকা শব্দে ভয় পেয়ে ফুলবানু ফরিদকে জড়িয়ে ধরে।  ফরিদ ফুলবানুর ভয়ের রেশ কাটানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ফুলবানু ফরিদকে জাপটে ধরে। তার বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে থাকে। ফুলবানুর নাক-মুখের গরম নিঃশ্বাস ফরিদের মধ্যে কামনার মাতম তুলে দেয়। ফুলবানু শক্ত করে ধরে গোঙাতে থাকে। ফরিদও অস্থির ফুলবানুকে জড়িয়ে ধরে। তারপর দুজন দুরন্ত গতিতে ভেঙে চৌচির হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে দুটি নিথর দেহ সুখের আবেশে ক্লান্ত হয়।

বেশ কিছুক্ষণ পরে বৃষ্টি থেমে যায়। ফুলবানু নিজেকে গুছিয়ে বিদায় নেয়। চলে আসার সময় ফরিদকে বলে, চাষী এরাম সুক আমি বিয়ির পর হতি পাইনি। তুমার মুরোদ আচে। আমি আবার কিন্তু আসবানে।

ফরিদ চুপচাপ থাকে। নিজের মধ্যে এক নতুন পরিবর্তন লক্ষ্য করে। ফুলবানু বের হয়ে যায়। অপার আনন্দে ফুলবানুর চলে যাওয়া দেখে।

 

*

আজকাল ফুলবানু সেন্টুর সাথে অকারণে খারাপ ব্যবহার করে। সেন্টু বুঝতে পারে না ফুলবানুর হঠাৎ হঠাৎ মেজাজ বিগড়ে যাওয়ার কারণ। মাঠে দুপুরে ভাত দিতে গেলে সেন্টুর সাথে কোন কথা বলে না। দু'একটা কথা যা বলার ফরিদের সাথে হয়। সেন্টুর তাই সবসময় মন খারাপ থাকে। সেদিন রাতে সেন্টু ফুলবানুকে সোহাগ করতে চায়। ফুলবানু একেবারে পাশে ভিড়তে দেয় না সেন্টুকে। প্রচন্ড ক্ষোভে সেন্টু বলে, তুই কিন্তু সীমা ছাড়াই যাচ্চিস বউ।

ফুলবানুও ঝটপট উত্তর দেয়, সীমার আবার দেকিচো কি! সামনে আরো দেকতি পাবা।

সেন্টু আরও অস্থির হয়ে ওঠে। চিৎকার করে বলে, তুই এরাম কত্তিচিস ক্যান, জানতি পারি ?

জেনি কি করবা কও। খালিতো মনের আগুন জ্বালাতি পার, নিভাতি তো পার না। আমি কি মানসের বাচ্চা না? নিজের সুক নিয়ি দুমিনিট পরেই ফুটুস। আর কতো জ্বালা সবো। আর না। দুচোখ যেদিক যায়, চুলি যাব।

ফুলবানুর অগ্নিমূর্তি দেখে জলের মতো ঠান্ডা হয়ে যায় সেন্টু।

ফুলবানুর সাথে ফরিদের যে বিশেষ একটা সম্পর্ক হয়েছে তা সেন্টু বুঝতে পারে। কিন্তু তার কাছে কোন প্রমাণ না থাকায় সে এর কোন প্রতিকার করতে পারে না। তার দুঃশ্চিন্তা ক্রমশ বাড়তে থাকে। তার ইচ্ছে করে সবাইকে জানিয়ে দিতে কিন্তু পারে না। একটা বিষয় তাকে বেশি বিচলিত করে, ফুলবানুকে শারিরীক বা মানসিক কোনভাবেই সে সুখি করতে পারেনি। এখন যে ফুলবানুকে সে দেখছে, এ এক অচেনা ফুলবানু। ধীরে ধীরে ফুলবানু তার কাছে অপরিচিত এক মানুষে পরিণত হয়। সংসারের অভাবের পাশাপাশি ফুলবানুকে হারানোর কষ্ট, নিজের পুরুষত্বহীনতা নানান সংকট তাকে ঘিরে ফেলল চারপাশ থেকে। একসময় সেন্টু অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রায় তার বুকের বাঁপাশে চরম ব্যাথা অনুভুত হয়। হঠাৎ একদিন সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। গঞ্জের হাসপাতালে চিকিৎসা হয়। কিন্তু সেন্টু আর সুস্থ হয়নি। পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে। চিরকালের জন্য অচল হয়ে যায়।

 

*

সেন্টুর প্রতি ফুলবানুর অবহেলা দিন দিন বেড়েই চলে। নিথর সেন্টু তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করে। কিন্তু তার আর প্রতিবাদের কোন উপায় নেই। বেপরোয়া ফুলবানু সবকিছু উপেক্ষা করে। ইশারা ঈঙ্গিতে যা কিছু বলে ফুলবানু তা আমলে নেয় না। ফরিদের সাথে তার অবাধ মেলামেশায় বাধা দেওয়ার আর কেউ নেই। ফরিদ অবশ্য এতটা অবাধ্য হতে চায় না কিন্তু ফুলবানুর আহবান সে উপেক্ষা করতে পারে না। একদিন গভীর রাতে ফুলবানুর ঘরে ফরিদ আসে। নিথর শরীরে ঘুমহীন চোখে সেন্টু দেখে। তাদের উন্মুক্ত বেপরোয়া যৌন জীবনের একমাত্র স্বাক্ষী সেন্টু তার কোন প্রতিকার করতে পারে না। শুধু অবাক বিস্ময়ে দেখা ছাড়া তার আর কী করার আছে। এভাবে ফরিদ প্রায়ই ফুলবানুর কাছে আসে।

সেন্টুর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার পরে দবির মেম্বার এর সব জমিই এখন ফরিদ একা বর্গা চাষ করে। ভালো পয়সা তার পকেটে আসে। ফুলবানুর যখন যা দরকার ফরিদ দেয়। এছাড়া সেন্টুর ঔষধপত্রের জন্যও টাকা দেয় ফরিদ। সেন্টুর জন্য তার মাঝে মধ্যে কষ্ট হয় কিন্তু ফুলবানুর মোহে এতটা ডুবে থাকে যে সেসবের হিসাব মিলাবার সময় তার নেই। একদিন স্ত্রী জয়নবের এক স্বপ্ন দেখে ফরিদের ঘুম ভেঙে যায়। সে বিচলিত হয়ে ওঠে। স্বপ্নে জয়নব তারে জিজ্ঞেস করে, এসব কি কুত্তিচাও আসলামের বাপ।

কী কত্তিচি ? ক্যান তুমি জানোনা না ?

ইডা পাপ, আসলামের বাপ। তুমিতো এরাম ছিলে না পাপ কচ্চিস ক্যান। আমি কি মানসের বাচ্চা না। আমি কি কুত্তার বাচ্চা। আমার স্বাদ আহলাদ থাকতি পারে না ?

তা কি আমি কতিচি? কিন্তু সিডা ক্যান পাপের রাস্তায় কত্তি হবে? ফরিদের সমস্ত শরীরে ঘাম ঝরতে থাকে। সে ভাবে জয়নব তারে কি বলল। তার ঘুম হারাম হয়ে যায়। রাতের বাকি অংশে তার আর ঘুম আসেনি।

 

*

সেন্টু হঠাৎ মারা যায়। তারপর ফুলবানু কিছু দিন বাবার বাড়িতে থাকে। স্বামীর শোক অল্প কিছু দিনের মধ্যে কাটিয়ে ওঠে। ফরিদের জন্য উন্মাদ হয়ে যায়। শ্বশুর বাড়ি চলে আসে। প্রতিবেশীরা সবাই তাকে বাবার বাড়িতে চলে যেতে বলে। তারা বলে সন্তানহীন ফুলবানুর এখানে থেকে কি হবে। কিন্তু ফুলবানুর অন্তরে ফরিদ অনেক যায়গা জুড়ে আছে। ফরিদের মায়ার জালে ফুলবানু আটকা পড়ে। অন্যকিছু ভাবার তার ফুরসত নেই। সে যেভাবেই হোক ফরিদকে পেতে চায়। ফরিদের সাথে কথা বলে। বলে, চাষী পতের সব কাটাতো সুরি গেল। এবার আমারে তুমার ঘরে তুলি নেও।

ফরিদ কোন কথা বলে না। তাকে নীরব দেখে ফুলবানু বলে, কুতা কওনা ক্যান ?

কী কব ?

আমারে তুমার কুরি নেও।

সিডা কি কুরি সম্ভব।

ফরিদের কথা শুনে ফুলবানু থমকে যায়। তার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয় না। শুধু জানতে চায়, ক্যান সম্ভব না।

ইডা অন্যায় ফুলবানু।

কী কতি চাচ্চ পরিস্কার কুরি কও।

সুমাজের মানুস কি কবে। তাছাড়া সেন্টুরে আমি মেলা কষ্ট দিচি। আর দিতি চাইনে।

ফুলবানু নিথর হয়ে যায়। রাগে অভিমানে তার মুখ লাল হয়ে ওঠে। রাগঢাক না করে সরাসরি বলে, আগে ইডা ক্যান ভাবোনি চাষী? তুমার জন্যি পারিনি। ক্যান আমি তুমার কি করলাম যে তুমি ভাবতি পারোনি। ফরিদ কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে, ভাবার সুমায় দিচাও। ফুলবানু আর কিছু বলে না। তার সমস্থ শরীর অবশ হয়ে যায়। ফরিদের এরকম সিদ্ধান্তের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। শুধু একবার অসহায়ের মতো ফরিদের দিকে তাকায়। একটা কষ্টের নিঃশ্বাস ফেলে। অস্ফুটস্বরে বলে, ভালো থেকো চাষী। তুমার মেলা জ্বালাতন করিচি। কুতা দিলাম আর কুনো দিন তোমার সামনে এসি দাড়াবোনা। ফরিদ মুর্তির মতো দাড়িয়ে থাকে। ফুলবানু দ্রুত চলে যায়।

 

*

ঐদিন সারা রাত ফুলবানুর ঘুম হয়নি। শুধু জীবনের এই কঠিন সময়ে সেন্টুর কথা মনে পড়ে। আর যাইহোক সেন্টুতো কোন প্রতারক ছিল না। তার যে সমস্যা ছিল সেটা একধরনের অসুস্থতা। এতে তো সেন্টুর কোন হাত নেই। ফুলবানু আর ভাবতে চায় না। শুধু ভোরের অপেক্ষায় থাকে।

খুব ভোরে ফুলবানু এক কাপড়ে ঘর ছাড়ে। সেন্টুর কবরের কাছে যায়। অঝোরে কাদতে থাকে। সেন্টুর কাছে ক্ষমা চায়। আর ফরিয়াদ করে বলে, হে খোদা আমি পাপী, আমার কুনো ক্ষুমা নেই জানি কিন্তু আমার সেন্টুরে তুমি আঁচান দিও। তার কুনো অপরাধ নেই।

 

*

শোনা যায় ফরিদ আবার বিয়ে করে সংসারী। তার ব্যস্ত জীবনে ফুলবানুর কথা হয়তো মনে পড়ে না। সবার অলক্ষ্যে তার আর ফুলবানুর ঘটনা চাপা পড়ে। কিন্তু ফুলবানুকে আর কোনদিন এ জনপদে দেখা যায়নি।

 

Page No 1