writerfair

ক্ষত

wound

Wahid Zaman

প্রথম অংশ

ফয়সালের সাথে জেবার বন্ধুত্ব ক্লাস সিক্স থেকে। একসাথে স্কুলে যাওয়া, খেলা করা। এলাকার সকলে এদের দুজনকে মানিকজোড় বলত। ফয়সালদের বাড়ি থেকে জেবার বাড়ি কয়েক মিনিটের পথ। এজন্য কারণে অকারণে এ ওর বাড়িতে আসতে বিশেষ কোন অসুবিধা হত না। ফয়সাল ছাত্র হিসাবে অনেক মেধাবী। বরাবরই সে ক্লাসে প্রথম। অনেকেই তার প্রথম স্থান দখলের চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি। জেবা সম্পূর্ণ বিপরীত। সবসময় খুড়িয়ে খুড়িয়ে ক্লাসে উঠেছে। অবশ্য এজন্য ফয়সাল কখনো তাকে ভৎর্সনা করেনি। বরং কোন বিষয় যদি বুঝতে অসুবিধা হত ফয়সাল তা বুঝিয়ে দিত। এভাবে তারা ক্লাস টেন-এ উঠল। এতদিনে দুজনের বন্ধুত্ব ভালোই চলছিল। কিন্তু বিপত্তি দেখা দিল ফয়সালের। জেবাকে তার ভালো লাগতে শুরু হলো। হবে না কেন? ক্লাস টেন-এ উঠার পর জেবা হলো এক পূর্ণ যুবতী। নারী সৌন্দর্যের সব পশরা যেন তার দেহে ভর করেছে। তার চোখ, গ্রীবা, ঠোঁট, নিতম্ব এবং সর্বোপরি তার সুডৌল স্তনযুগল যে কোন পুরুষকে আকর্ষণ করবে। মোদ্দা কথায় অপরূপ নারী বলতে যা বোঝায় জেবা তাই। ধীরে ধীরে ফয়সালের আচারণে পরিবর্তন দেখা গেল। সে জেবাকে আলাদা নজরে দেখতে লাগল। চালচলন, কথা বলার একধরনের অভিভাবকসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা গেল। প্রথমটায় জেবা বুঝতে পারেনি। কিন্তু ফয়সালের আচরণ দেখে তার বুঝতে আর বাকী রইল না। ফয়সাল বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলো কলেজে উঠে। জেবার সাথে কোন ছেলে কথা বললে, সে ভীষণ ক্ষেপে যেতো। জেবাকে শাসাত। জেবা ভেজা বেড়ালের মত দাঁড়িয়ে থাকত। কোন কথার জবাব দিত না। একদিন কলেজের এক অনুষ্ঠানে কে একজন জেবাকে ফুল দিয়েছিল। তাই নিয়ে ফয়সাল এক তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে বসল। ইটের টুকরো দিয়ে মাথায় আঘাত করে ছেলেটাকে রক্তাক্ত করে ফেলল। সবাই হতবিহ্বল। অনেকেই ছি ছি করল। কেউ বিশ্বাস করতে পারছিল না যে ফয়সালের মত এত ভালো ও মেধাবী ছাত্র এমনটি করতে পারে। জেবা ঐ মুহূর্তে কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। ফয়সাল কে না বলে বাসায় চলে এলো। এই ঘটনার পর থেকে জেবা ফয়সালকে এড়িয়ে চলত। ফয়সাল প্রতিদিন কলেজ যাওয়ার সময় রাস্তায় জেবার জন্য অপেক্ষা করত। জেবা জানত ফয়সাল তার জন্য অপেক্ষা করে। তাই মাঝে মধ্যে সময়ের ব্যবধান করে বা পথ পরিবর্তন করে কলেজ যেত। ফয়সাল কেমন যেন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল। জেবার এই এড়িয়ে চলা সে আর সহ্য করতে পারছিল না।

Page No 1


দ্বিতীয় অংশ

একদিন রাতে ফয়সাল জেবাদের বাড়িতে হাজির। জেবা অসময়ে ফয়সালকে দেখে অবাক হল। জেবার মা ফয়সালকে বলল, হঠাৎ এসময়ে কেন, বাবা? বাড়িতে কোন অসুবিধা হয়নি তো? উত্তরে ফয়সাল বলল, না কাকীমা। সামনে ফাইনাল পরীক্ষা তো, তাই জেবাকে একটা নোট দিতে এলাম। কাল কলেজে এ পড়াটি আছে। শুনে জেবার মা বলল, ভালো হয়েছে বাবা। তোমাদের লেখাপড়া তোমরাই বোঝ। বলে তিনি ওপাশের রুমে গেলেন। ফয়সাল জেবার সামনে যেতে লজ্জা পাচ্ছিল। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল। মনে মনে ভাবছিল, এমন জঘন্য কাজ সে না করলেও পারত। যাইহোক কালবিলম্ব না করে একটা চিরকুট জেবার টেবিলের পরে ছুঁড়ে দিয়ে বাড়ির সবাইকে শুনিয়ে বলল, 'ভালো করে পড়িস। এসবই কিন্তু পরীক্ষায় কমন আসবে।' বলে দিল ভো-দৌড়। ফয়সালের কাণ্ড দেখে জেবার ভীষণ হাসি পাচ্ছিল। তারপর আস্তে চিরকুটটি খুলল। লেখা আছে- জেবা, সেদিনের ঐ ঘটনার জন্য সত্যি আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত ও লজ্জিত। আসলে কেন আমি এমন বেপরোয়া হয়েছিলাম, ঠিক তোকে বোঝাতে পারব না। আমি এমনটা করতে চাইনি। সাগর যখন তোকে ফুল দিল আর তুই গ্রহণ করলি- ঠিক তখনই আমার মাথা ওলোট- পালোট হয়ে গেল। আমি তোকে কথা দিচ্ছি, আর কখনও এমনটা হবেনা। প্লিজ, আমাকে এড়িয়ে চলিস না। সকলের অপমান সহ্য হলেও তোর অবজ্ঞা আমি একদমই সইতে পারি না। তোর সাথে আমার একটা বিশেষ কথা আছে। কথাটা তোকে শুনতেই হবে। - ফয়সাল। পড়ে জেবা কিছুটা হাসল। আবার একটা গভীর ভাবনা তাকে আচ্ছন্ন করলো নিমিষেই। কলেজে ফয়সাল জেবাকে খুঁজছে। হঠাৎ জেবাকে আবিষ্কার করল। শহিদ মিনারের একধারে বসে জেবা দূরের আকাশপানে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে। ফয়সাল আগে কখনো জেবাকে এতটা নির্মোহ, নির্জন দেখেনি। তাই পাশে যেতে কেমন যেন লাগল। পিছনে গিয়ে ফয়সাল বলল, 'তুই এখানে? আর আমি তোকে সারা কলেজ খুজছি।' জেবা কোন কথা বলল না। ফয়সাল পাশে বসল। কীভাবে শুরু করবে, বুঝতে পারছিল না। হঠাৎ নিরাবতা ভেঙে জেবার হাত জাপটে ধরল। জেবা লাফিয়ে উঠল। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই ফয়সাল বলল, 'কোথাও যাবি না। আমার কথাটা শোন। আমি তোকে ভালোবাসি। তোকে ছাড়া আমি বাঁচব না।' জেবা সজোরে হাত ছাড়িয়ে চলে গেল। ফয়সাল দূরের কার্ণিশ ধরে যতদূর চোখ যায় জেবার হেটে যাওয়া দেখল। জেবার পরিবার ছিল কিছুটা রক্ষণশীল। এইচএসসি পরীক্ষার পরে জেবার বিয়ে তার বাবা-মা পাকাপোক্ত করে রেখেছিলো। ছেলের বয়স জেবার প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু বিয়েতে ওর বাবা-মার রাজি হওয়ায় কারণ ছিল, ছেলে অনেক পয়সাওয়ালা ও সম্পদশালী। জেবা এ বিষয়ে কিছু জানত না। ওর পরিবার এটি গোপন রেখেছিলো। কারণ ভালো পাত্র। লোক জানাজানি তে যেন হাত ছাড়া না হয়। এদিকে ফয়সালের কোন কিছুতে মন বসে না। জেবার কাছ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে কেন জানি তার সবকিছু এলোমেলো মনে হতে লাগল। এরই মধ্যে পরীক্ষা শেষ হলো। এখন ফয়সালের হাতে অফুরন্ত সময়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার পড়া ছাড়া আর কোন কাজ নেই তার হাতে।

Page No 2


তৃতীয় অংশ

একদিন বিকেলে ফয়সাল অবাক হয়ে গেল। হঠাৎ জেবা এসে হাজির। ফয়সালের বিশ্বাসই হচ্ছিল না। অনেক দিন পরে জেবাকে দেখে ফয়সাল কথা হারিয়ে ফেলল। অকস্মাৎ জেবাকে বলল, হঠাৎ কী মনে করে?


জেবা বলল, তোমাকে দেখতে এলাম।
আমি কি চিড়িয়াখানার প্রাণী, আমাকে দেখতে আসবি। তুমি এমনভাবে কথা বলছ, যেন আমাকে চেন না। ফয়সাল একটু ক্ষেপে বলল, আসল কথাটা কী বল?'

তোমার সাথে আজ ঘুরতে যাব।
জেবার এই কথা শুনে ফয়সাল বিষ্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল। না করতে পারল না।
ওরা গ্রামের ঐ প্রান্তে বিশাল নারিকেল বাগান ওদিকটায় গেল। ফয়সাল ভাবল আজ সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। কোনদিন ভাবতেও পারেনি জেবা তার কাছে এমন একটি আবদার করবে।


অনেক ঘুরল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল প্রায়। এদিকে পূব আকাশে ঘনকালো মেঘ জমেছে। চারিদিকে দমকা বাতাস। জেরা ঘরে ফেরার তাগিদ দিল। ফয়সালও সম্মতি দিল। নারিকেল বাগানে দমকা বাতাস অতিক্রম করে আসতে লাগল। পথিমধ্যে প্রচণ্ড বৃষ্টি আর ঝড় শুরু হলো। অগত্যা উপায় না দেখে বাগানের ভেতরে একটা কুটিরে আশ্রয় নিল। বোধহয় বাগানের পাহারাদার এ কুটিরে থাকে। ভীষণ ঝড়- বৃষ্টি। হঠাৎ বিকট শব্দে পাশে কোথাও বজ্রপাত হল। ভয়ে হতচকিত হয়ে জেবা ফয়সালকে শক্ত করে জাপটে ধরল। কেমন যেন শিশুর মত কাঁপতে লাগল। নির্জন এ কুটিরে দুটি প্রাণী ছাড়া আজ আর কেউ নেই। দিকশূন্য জেবা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফয়সালকে আপনকরে জড়িয়ে থাকল। আজ যেন মেঘ নিয়ন্ত্রণহীন। প্রবল বৃষ্টি ও বজ্রপাত ঘটেই চলল। ফয়সাল ক্রমশ নিজেকে হারিয়ে ফেলতে লাগল। তার চিরকালের ভালোবাসার ধন আজ তার আপন মুঠোয়। ধীরে ধীরে নিজের ভেতর কেন জানি একটা অনুভূতি কাজ করতে লাগল। হঠাৎ নিজের নিয়ন্ত্রণ ভেঙে জেবাকে চুমোয় চুমোয় ভরে দিতে লাগল। জেবাও নতুন আস্বাদনে নিজেকে হারিয়ে ফেলল। এভাবে অনেকক্ষণ কাটল তাদের। তারপর বৃষ্টি থামল। ঝড় থামল। দুজন দুজনকে আবিষ্কার করল নতুন ভাবে।

 

Page No 3


চতুর্থ অংশ

পরীক্ষায় ফয়সাল কলেজের সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করল। জেবা পাশ করল কোন রকমে। তাতে ফয়সাল খুশি। ফয়সাল ঢাকা এল ভর্তিপরীক্ষা দিতে। টিকে গেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল আঙিনায় তার ভালো লাগে না। জেবার কথা বার বার মনে পড়ে।


এদিকে জেবার অমতে পরিবারের পূর্ব নির্ধারিত ছেলের সাথে জেবার বিয়ে হয়। এই শোক কাটিয়ে উঠতে ফয়সালের অনেক দিন লেগেছে। এখনও মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে আঁতকে ওঠে।
ফয়সাল এখন মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে সহপাঠী সুমানার সাথে প্রেম করে। ফয়সাল কখনো কখনো ভাবে, সুমানা কি করবে জানি না? এসব মডার্ন মেয়েদের মতিগতি বোঝা মুশকিল। সুসভ্য জগতে এরা বড়ই দুরন্তপনা। ফয়সাল জেবার কথা সুমানাকে বলেছে। সুমানা কিছু মনে করেনি। প্রেম বিষয়ে অভিজ্ঞ ছেলেদের সুমনার পছন্দ। ওর ধারণা এসব আবেগমাত্র, প্রেম নয়। ভালোবাসার ব্যাপারে সিরিয়াস কিছু নেই।
চিরাচরিত গন্ডগোলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হল। ফয়সাল অনেক দিন বাড়িতে যায় না। বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। ট্রেনের টিকিট কাটল। পরের দিন সন্ধ্যা সাতটা।
রাতে ফয়সালের ঘুম হলো না। অনেকদিন পরে হঠাৎ জেবার কথা মনে পড়ল। গত ঈদে বাড়িতে গেলে তার মা বলেছিল জেবার শ্বশুর বাড়ি যেতে। ঢাকা থেকে সাতক্ষীরা যাওয়ার পথে জেবার শ্বশুর বাড়ি যশোরে।
জেবা যখনই বাবার বাড়ি আসে, ফয়সালের মাকে অনুরোধ করে যায়, ফয়সাল যেন তার শ্বশুর বাড়িতে যায়। ফয়সাল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এবার সে জেবার ওখানে ঘুরে যাবে। তাইতো ট্রেনের টিকিট কাটল।
ট্রেনে ফয়সালের কেমন যেন সংকোচ হচ্ছিল। এতদিন পরে জেবার সামনে কীভাবে দাঁড়াবে। এসব আগপিছু ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল। কুলিদের ডাকাডাকি, যাত্রীদের হৈ-হুল্লোড়ে ঘুম ভেঙে গেল। যশোরে ট্রেন এসে পৌঁছে গেছে।
 

Page No 4


পঞ্চম অংশ

জেবার স্বামী কেমন যেন বেরসিক। একটুও ঠাট্টা-তামাশা বোঝে না। কারোর সাথে মিশে না। কথা কম বলে। চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু জেবার ছেলেটা সম্পূর্ণ বিপরীত। ভীষণ দুষ্ট। ফয়সালের সাথে বেশ ভাব হয়েছিল।


জেবা প্রথমে অবাক হয়েছিল। ফয়সালকে দেখে কোনো কথা বলতে পারেনি। মুখটা ছিল বিষাদে ভরা। ফয়সালকে পেয়ে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। জেবা ফয়সালকে দুদিন আটকে রেখেছিল। অনেক কথা, অনেক গল্প। জিজ্ঞেস করল, বিয়ে করো না কেন?
ফয়সাল বলল, লেখাপড়া শেষ হলে করব।
আমার কথা মনে পড়ে?
না
ভালো
জেবা আর কিছু বলেনি।


দুটো দিন ভালোই কাটল ফয়সালের। কখন যে বিদায়ের সময় হল বুঝতে পারেনি।
বিদায় বেলায় ফয়সাল বলল, কিরে সুখে আছিস?
আছিরে...সুখে আছি।


ফয়সাল হাঁটতে লাগল। কিছু পথ গিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখে জেবার চোখে জল। ওর আসতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। কিন্তু উপায় কী আছে? ফয়সাল বাড়িতে যায়নি। কেন জানি ঢাকার ট্রেনে আবার উঠে বসল। ট্রেন স্ববেগে ছুটে চলল। ট্রেনে ফয়সালের একটুও ভালো লাগেনি। শুধু ভাবল, জেবা কেন কাঁদল? আজ বুঝেছি, ও আমাকে ভীষণ ভালোবাসতো। হয়ত অসম ভালোবাসার অপবাদে ও আমাকে ধিকৃত করতে চায়নি। সমাজের মাঝে তাই ও আমার একান্তই গোপনীয় রয়ে গেল!
 

Page No 5